জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহর মৃত্যুরহস্য নিয়ে নাটক জমে উঠেছে। সালমানের মৃত্যুর ঘটনায় সন্দেহভাজন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী রাবেয়া সুলতানা রুবি গতকাল সকাল ৮টা ৩৪ মিনিটে এবং বেলা ১১টা ২৮ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে সালমান খুন হয়েছেন দাবি করলেও বিকাল ৫টা ৪৯ মিনিটে তার বক্তব্য থেকে সরে আসেন। সোয়া ৬ ঘণ্টার ব্যবধানে রুবির বক্তব্য পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে সালমানভক্তসহ বিভিন্ন মহলে। নিজেকে ‘মানসিক রোগী’ দাবি করে ফেসবুক লাইভে তিনি বলেন, মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ার কারণে সালমানের মৃত্যু নিয়ে তিনি ভুল তথ্য দিয়েছেন। অন্যদিকে, বহুল আলোচিত এই মামলাটি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন খোদ পুলিশপ্রধান। তদন্তসংশ্লিষ্টদের গতকাল নিজ কার্যালয় পুলিশ সদর দফতরে তলব করেছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। সূক্ষ্মভাবে তদন্তের জন্য তিনি মামলার সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটনের নিজ ফ্ল্যাটে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন ওরফে সালমান শাহর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন বিষয়টি আলোচনায় থাকে। তবে গত সোমবার জনপ্রিয় এই চিত্রনায়কের অপমৃত্যু মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন রুবির একটি ভিডিও প্রকাশের পর শুধু দেশে নয়, দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে অবস্থানরত সালমানভক্তদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। তাদের অংশগ্রহণে সরগরম হয়ে উঠেছে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এদিকে গতকাল বেলা ১১টা ২৮ মিনিটে রুবি তার ফেসবুক লাইভে আসেন। কথা বলেন টানা ৬ মিনিট ১ সেকেন্ড। এ সময় তার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা বন্ধুদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। রুবি বলেন, ‘সালমান শাহ খুন হোক কিংবা আত্মহত্যা করুক দুটোর মাঝেই তো সামিরা (সালমানের স্ত্রী) থাকবে। আমাকে কেন কথা বলতে হবে? সামিরারই তো এসব নিয়ে কথা বলা উচিত। তার হাজব্যান্ড কিংবা তার বাবা কেন কথা বলবে? সাড়ে ১৫ বছর ধরে আমি আমেরিকা আছি। সুষ্ঠু তদন্ত হলে ২১ বছর ধরে সালমান শাহর মৃত্যুরহস্য ঝুলে থাকত না।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি দাবি করেন, ‘আপনারা সামিরার চালচলন দেখেন, সে কীভাবে ঘুরে বেড়ায়! সে একটি কাপড়ের পুঁটলিতে কী যেন একটা আমার ছেলে ভিকিকে দিয়ে সরিয়ে ফেলেছিল। সে আমাকে এবং আমার ছেলেকে ফাঁসাতে চেয়েছিল।’ গতকাল বিকালে চিত্রনায়ক সালমান শাহর স্ত্রী সামিরার বাবা সাবেক ক্রিকেটার শফিকুল হক হীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি প্রথমেই বলেছিলাম রুবি মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ। তার কোনো কথাই যাতে কেউ বিশ্বাস না করেন।’ কীভাবে জানেন রুবি মানসিকভাবে অসুস্থ? এমন প্রশ্নের জবাবে হীরা বলেন, ‘তার চুল এবং চেহারা দেখে আপনারা বোঝেন না?’ ’৯৬-এর পরে রুবি কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি।
এর আগে সকাল ৮টা ৩৪ মিনিটে রুবি লাইভে এসে কথা বলেন ২৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড। ওই সময়ও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন সালমানের স্ত্রী সামিরার আচরণ নিয়ে। লাইভের একপর্যায়ে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘সামিরা কেন কথা বলে না? সামিরা কেন সামনে আসে না? ও কি ভিআইপি? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর থেকেও কি উপরে যে উনি কথা বলতে পারেন না? জনগণের সামনে আসতে পারেন না? কেন ওনার ভয়? কারণ কথা বলতে পারবে না তো, জবাব নাই তো।’ ভিডিওতে তিনি আবার বলেন, ‘এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা আমি জানি না। তবে ঠিকমতো যদি আবার সামিরা বা সামিরার বাবাকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে ঠিকই বের হবে।’ ৬ ঘণ্টার ব্যবধানে রুবি তার আগের সব বক্তব্য থেকে সরে আসেন। বিকাল ৫টা ৪৯ মিনিটে ফেসবুক লাইভে ৪ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের বক্তব্যে নিজেকের ‘মানসিক রোগী’ বলে দাবি করেন রুবি। বলেন, ‘মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার কারণে গত দুই সপ্তাহে আমি কানাডা এবং ফিলাডেলফিয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আমি যা কিছু বলেছি তার কোনো মূল্য নেই। আমি প্রমাণ দেব যে আমি অসুস্থ ছিলাম। সকালে আমার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছে। ওরা আমাকে নিয়ে চিন্তায় ছিল। আমার বড় ছেলে আমাকে এক মাসের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য বলেছে।’ চুলের অবস্থা দেখিয়ে নিজেকে মানসিকভাবে অসুস্থ দাবি করে রুবি বলেন, ‘আমি ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি। অসুস্থ থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে। এ নিয়ে কে কী মনে করল তাতে আমার কিংবা আমার হাজব্যান্ডের কিছু আসে যায় না। তবে যা কিছু হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত। যা বলেছি সব মিথ্যা কথা। কারও কোনো ক্ষতি হোক তা আমি চাই না।’ জানা গেছে, রুবি সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীর একসময়ের বান্ধবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী আবদুর রশিদের মেয়ে। থাকতেন সালমান শাহর ফ্ল্যাটের উত্তর পাশের বিল্ডিংয়ে। তার প্রথম স্বামী ছিলেন ক্যাপ্টেন জামিল। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে যে ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় জামিল ছিলেন তাদের একজন। ক্যাপ্টেন জামিলের সংসারে জন্ম নেওয়া পুত্র ভিকিকে নিয়ে ৩১ বছর আগে জনচেন নামের এক চাইনিজ নাগরিককে বিয়ে করেন তিনি। সালমানের মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর তিনি আমেরিকায় পাড়ি দেন। সেখানেই স্বামী-সন্তান নিয়ে বাস করছেন। আমাদের সিলেট ব্যুরোপ্রধান শাহ্ দিদার আলম নবেলের কাছে সালমানের মামা আলমগীর কুমকুম দাবি করেন, ‘উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণে সামিরাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে সালমানকে।’ আলমগীর কুমকুম যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। বর্তমানে তিনি থাকছেন সিলেট মহানগরের দাঁড়িয়াপাড়ায় সালমান শাহর বাসায়। ‘সালমান শাহ ভবনে’ কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘খুন চাপা থাকে না। সালমানের মৃত্যুর পর থেকে আমরা এ ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড দাবি করে আসছি। সালমান শাহর মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের জন্য সামিরা ও তার মা-বাবাকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করার দাবি জানাই।’ তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীরা সামিরা ও তার পরিবারের সদস্য এবং মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করলেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য বেরিয়ে আসবে।’ টেলিভিশনের টকশোয় সামিরার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলোচনায় বসলে নিজেই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রমাণ করতে পারবেন বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন কুমকুম।