শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

তোপখানা রোড এখন কি শুধুই ইতিহাস

মাহবুব মমতাজী


তোপখানা রোড এখন কি শুধুই ইতিহাস

তোপখানা রোড। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর একটি। ইতিহাসের সাক্ষী তোপখানা রোড। কামান ফারসি শব্দ। বাংলায় ‘তোপ’। মুঘল আমলে এই এলাকায় সেনাবাহিনীর কামান রাখার কয়েকটি ঘর ছিল। সেই থেকে এলাকাটির নাম তোপখানা। এখন ‘খানা’ নেই ‘তোপ’ নেই, আছে শুধু ‘রোড’। ১৯৮২ সাল থেকে তোপখানা রোড হয়ে ওঠে আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্র। নানা আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাত এখান থেকেই। তোপখানায় সেই আন্দোলনমুখর দৃশ্যও এখন আর নেই। অনেকেই মনে করেন ঘুমিয়ে আছে তোপখানা। একটা সময় ছিল মিছিলে-স্লোগানে মুখরিত থাকত তোপখানা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আলো প্রজ্বালন হতো। কখনো মোমবাতি জ্বেলে, কখনো মশাল নিয়ে বের হতো মিছিল। রাজনৈতিক সংকট, অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বাম রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। সেই সঙ্গে জনসম্পৃক্ত নানা দাবি নিয়ে রাজপথে অব্যাহত কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। যদিও এই দাবির সঙ্গে একমত নন বাম রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে। তাদের দাবি, সময় বদলাচ্ছে। তাই পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝেই কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। তোপখানা রোডে আছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, জাতীয় গণফ্রন্ট (টিপু বিশ্বাস), সাম্যবাদী দল, বাসদ (মাহবুব)-এর অফিস। এ ছাড়াও তোপখানা রোডে রয়েছে সদ্য ঘোষিত রাজনৈতিক দল নাগরিক ঐক্যের কার্যালয়। এতগুলো রাজনৈতিক দলের অফিস থাকলেও নেই আগের মতো রাজপথের কর্মসূচি। পোস্টার, লিফলেট বিতরণ ও ঘরোয়া আলোচনাতেই বেশির ভাগ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু ১০ বছর আগের চিত্রটা ছিল ভিন্ন। ২০০৬ সালের উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি প্রকল্প বাতিল, জাতীয় সম্পদ রক্ষা এবং বিদেশি কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে দিনাজপুর থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল বাম দলগুলো। প্রকল্পটিকে ‘ক্ষতিকর’ আখ্যা দিয়ে তা প্রতিরোধে সিপিবি, বাসদ ও বাম মোর্চা মিলে নানা কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ব্যানারে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, ঢাকা থেকে খুলনা ও ঢাকা থেকে ফুলবাড়িয়া লংমার্চ, সভা-সমাবেশ ও হরতাল পালন করা হয়। আন্দোলন করতে গিয়ে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট তৎকালীন বিডিআর ও পুলিশের গুলিতে ফুলবাড়িয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে সালেকিন, আল-আমিন ও তরিকুল নামে তিন যুবককে। শেষ পর্যন্ত ওই আন্দোলন সফল হয়েছিল বলে দাবি করেন বাম নেতারা। ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই মিছিল-স্লোগানে জেগে উঠত তোপখানা। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করেই জনসম্পৃক্ত দাবি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন নেতা-কর্মীরা। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ, পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে সরগরম ছিল তোপখানা। এমনকি এক-এগারোর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও ২০০৮ সালের ১৩ জানুয়ারি তোপখানা রোড কেঁপে উঠেছে মিছিলে-স্লোগানে। মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করেছে সিপিবি, বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বাধীন গণমুক্তি আন্দোলন। সেদিন সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবে সমাধানের দাবি জানিয়েছিলেন তারা। রাজনৈতিক নানা ইস্যু রয়েছে এখনো। কিন্তু আগের মতো মিছিল-সমাবেশ নেই। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো এখন বহু ভাগে বিভক্ত। রয়েছে মতানৈক্য। এর মধ্যে জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলে। সরকারে দুজন মন্ত্রী রয়েছেন এই দুটি দলের। তা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে সেভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারছেন না তারা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমল থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতা নির্মল সেনের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের অফিসও ছিল এখানেই। বিএনপি সরকারের সময় নিজ দলের অফিসের গলির মুখে অজ্ঞাত আততায়ীদের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই যে, সমাজ-রাষ্ট্রের জাগ্রত বিবেক বলে আখ্যায়িত সাংবাদিকদের মিলন কেন্দ্র জাতীয় প্রেস ক্লাবও এই তোপখানা রোডেই অবস্থিত। নানা আন্দোলন-সংগ্রাম ও ইতিহাসের সাক্ষী তোপখানা রোড কি শুধুই ইতিহাস।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর