শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ চরমে

তাঁবুতে কাদাপানি, রাখাইন জ্বলছে, থামছে না অনুপ্রবেশের স্রোত

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে

বৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ চরমে

উখিয়ার কুতুপালংয়ের বিস্তৃত পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের নতুন অস্থায়ী ক্যাম্প। টেকনাফ মহাসড়ক থেকে যার দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। ওই ক্যাম্পে যেতে মাত্র ৫০০ গজ পর্যন্ত ইটের সলিং। তাও কর্দমাক্ত। এরপর নতুন ক্যাম্পে দুর্ভোগের  শুরু। গতকাল দিনভর মুষলধারে বৃষ্টিতে হাঁটু সমান কাদা পেরিয়ে যেতে হয় নতুন তাঁবুগুলোতে। তবুও থেমে নেই ক্ষুধাতুর রোহিঙ্গারা। ফজরের আজানের পরপরই নারী-পুরুষ সবাই বেরিয়ে পড়েন ত্রাণের সন্ধানে। তবে সেখানে থাকা সহস্রাধিক তাঁবু এখন বসবাসের অযোগ্য। উপরে ত্রিপল থাকলেও নিচে কাদাপানি। আবার টুপটুপ করে ত্রিপলের ছিদ্র দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে পানি। পিচ্ছিল পাহাড় থেকে তাঁবুতে যাতায়াত করাও কষ্টসাধ্য। এই চিত্র শুধু কুতুপালংয়ের নতুন ক্যাম্পেই নয়, উখিয়া, টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি, ঘুমধুমসহ অধিকাংশ ক্যাম্পে একই অবস্থা।   

গতকাল ভোর থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি ছিল উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন স্থানে। তারপরও বিভিন্ন পয়েন্টে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয় বেসরকারি ও ব্যক্তি বিশেষের ত্রাণ। দিনভর ত্রাণের জন্য রোহিঙ্গাদের ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। টেকনাফ থেকে উখিয়ার ২০ পয়েন্টে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। সেখানে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটু পর্যন্ত কাদাপানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ত্রাণপ্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের। এর মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি। বালুখালী মাঠে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। মাঠে অন্তত ৫ হাজার রোহিঙ্গা কাদাপানিতে দাঁড়িয়ে ছিল ত্রাণের অপেক্ষায়। অনেকের মাথার ওপর বার্মিজ ও ইউএনসিএইচআরের দেওয়া ছাতা। শিশুদের বড় একটি অংশই খোলা আকাশে বৃষ্টিতে ভিজছিল। অনেককেই দেখা গেছে ত্রাণের বোঝা মাথায় নিয়ে তাঁবুর দিকে ফিরতে। কুতুপালং নতুন ক্যাম্পে ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ের ঢালুতে এবং পাদদেশে থাকা তাঁবুগুলোতে কাদাপানি। ভিতরে অনেক রোহিঙ্গা নারী রান্নার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কেউ কেউ তাঁবু থেকে মালামাল সরিয়ে অন্যত্র রাখায় ব্যস্ত। তাঁবুর ভিতরে বাচ্চাদের কান্না ও হাঁচি-কাশির শব্দও শোনা যায়। পাহাড়ের পাদদেশে থাকা একটি তাঁবুতে কথা হয়ে হাসিনা বেগম নামে মধ্যবয়সী নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর গুলিতে তার স্বামী মারা গেছেন। চার মেয়ে ও তিন ছেলেকে নিয়ে কোনোমতে তুমব্রু সীমান্ত নিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন তিনি। কয়েক দিন তাঁবু না পেয়ে রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচেই ছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। গত বুধবার একে ওকে ধরে নতুন ক্যাম্পে তার একটি তাঁবু খাটানোর জায়গা মেলে। কিন্তু তাঁবুতে এসেও এক বেলার জন্যও শান্তিতে থাকতে পারেননি তিনি। হয় প্রখর রোদ কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি। বাচ্চারাও নানা রোগে আক্রান্ত। তাদের রেখে ত্রাণ আনতে গেলেও নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বেলা সাড়ে ১১টা। কুতুপালং ক্যাম্পের অন্য একটি তাঁবুর ভিতরে রোহিঙ্গা মহিলা মাটির চুলায় আগুন জ্বালাতে ব্যতিব্যস্ত। কাছে গিয়ে কী রান্নার প্রস্তুতি চলছে— জিজ্ঞাসা করতেই রাবেয়া বেগম নামে ওই মহিলা তাদের ভাষায় যা জানালেন তার অর্থ— ‘বৃষ্টির জন্য কিছুই রান্না করা যাচ্ছে না। চুলোর নিচে পানি জমে থাকায় সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করেও আগুন জ্বালাতে পারিনি। ছেলেমেয়েরা না খেয়ে বসে আছে। কিছু বিস্কুট ছিল তা দিয়েছি। দুপুরে রান্না করতে না পারলে কী খাওয়াবো জানি না।’

বেলা সাড়ে ১২টা। কুতুপালং পেছনে রেখে বালুখালীর দিকে যেতেই চোখে পড়ল শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। অনেক রোহিঙ্গা নারীর কোলে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজছে তাদের ছোট ছোট শিশু। মাথায় ছাতা নেই, কোনো দোকানপাটের সামনে দাঁড়াবে সে সুযোগও নেই। এমনকি কোনো বাহনে চড়ে নিজেদের ক্যাম্পের দিকে যাবে এমন পরিস্থিতিও নেই। রাস্তায় ছোট ছোট টমটম ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলোও তখন যাত্রীতে ঠাসা। তাই ঝুম বৃষ্টিতে শিশুকোলে ঠাঁই দাঁড়িয়েই থাকতে হয়েছে তাদের। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের এই করুণ দশা দেখে অনেক পথচারী ও ত্রাণ টিমের সঙ্গে আসা ব্যক্তিকে নগদ টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করতে দেখা গেছে।  এদিকে মিয়ানমার আরাকান রাজ্যের মংডু থানার কিছু রোহিঙ্গা পাড়ায় গতকালও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার পর এখন মিয়ানমার সেনা ও বিজিপি সদস্যদের মদদে স্থানীয় মগরা রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা চাষাবাদের জমিতে আগুন দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পার হয়ে আসা রোহিঙ্গা আবদুল হামিদের পরিবারের সঙ্গে কথা হয় টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের পালংখালী পানবাজার এলাকায়। ওই পরিবারের সদস্যরা গত বুধবারই পার হয়ে আসেন এ পারে। তারা জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেখানকার পুলিশ অত্যাচার, নির্যাতন ও খুন ধর্ষণের মাত্রা আগের চেয়ে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে তারা কাউকে থাকতে দিচ্ছে না। উখিয়া ও টেকনাফের ন্যাড়া পাহাড়গুলো এখন আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অতিবৃষ্টির কারণে যে কোনো সময় এখানে পাহাড়ধসের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থীরা শুরুতে কোনো কিছু জানার আগেই এখানের শতাধিক পাহাড় ও সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের বনভূমি কেটে তাঁবু খাটিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি বরাদ্দের দুই হাজার একর ভূমির বাইরে যারা অবস্থান নিয়েছেন, প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানে নামায় তারা সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পের দিকে চলে যাচ্ছেন। ফলে ক্ষতবিক্ষত পাহাড়গুলো এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ খবর