শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অভয়ারণ্য ছেড়ে লোকালয়ে বন্যপ্রাণী

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান শেষ

দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, শ্রীমঙ্গল

অভয়ারণ্য ছেড়ে লোকালয়ে বন্যপ্রাণী

দেশের সাতটি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান অন্যতম। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান দেশের সমৃদ্ধতম বনগুলোর একটি। এ বন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং বন্যপ্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। লাউয়াছড়া বনেই রয়েছে বিলুপ্তের দ্বারপ্রান্তে চলে আসা বন্যপ্রাণী  উল্লুক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মনুষ্যসৃষ্ট ধ্বংসলীলায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ছেড়ে বন্যপ্রাণীরা এখন লোকালয়ে বেরিয়ে পড়ছে। লোকালয়ে বেরিয়ে আসা কিছু প্রাণী ধরা পড়ছে মানুষের হাতে। আর কিছু মারা যাচ্ছে সড়কে গাড়ির চাপায় পিষ্ট হয়ে। আর কিছু মারা যাচ্ছে রেলে কাটা পড়ে। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় বিস্তৃত মৌলভীবাজার রেঞ্জের ২ হাজার ৭৪০ হেক্টর আয়তনের ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। বনবিভাগের মতে, জাতীয় উদ্যানে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভোচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির অর্কিড, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করে, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে বনে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ায় বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে চলে আসছে। আর লোকালয়ে আসতে গিয়ে রেল বা সড়ক পথে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া বনের ভিতর অধিক পরিমাণ মানুষ প্রবেশ করায় নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে প্রাণীদের আবাসস্থল। বন বিভাগের তালিকানুযায়ী এক বছরে বিভিন্নি প্রজাতির প্রায় একশটি বন্যপ্রাণী লোকালয়ে ধরা পড়ে। উদ্ধারকৃত প্রাণীর মধ্য রয়েছে মায়া হরিণ, অজগর, লজ্জাবতী বানর, ইন্ডিয়ান রুইটড টারটল, গুইসাপ, তিলা ঘুঘু, ভারতীয় মোল, রেসাস বানর, সঙ্খিনী সাপ, বন বিড়াল, বন্য শুকর ও বিভিন্ন প্রকারের পাখি। এদের মধ্য একটি ভারতীয় মোল, একটি অজগর, একটি রেঁসাস বানর, একটি লজ্জাবতী বানর ও একটি মায়া হরিণকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আহত বন্যপ্রাণীদের চিকিৎসার জন্য জানকীছড়া বন বিটে রেসকিউ সেন্টারটি পড়ে আছে অব্যবহূত অবস্থায়। ডাক্তার তো দুরের কথা প্রাথমিক চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই উদ্ধার হওয়া আহত প্রাণীদের চিকিৎসা দিতে স্থানীয় পশু হাসপাতালের ডাক্তারের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় ছুটতে হয় বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ছয় মাসে রেল ও সড়ক পথে মারা গেছে ১৩টি লোপার্ড, ছয়টি গন্ধ গকোল, পাঁচটি বানর, চারটি মায়া হরিণ, একটি লিজার্ড, একটি সঙ্খিনী, একটি অজগর, চারটি দাঁড়াশ, একটি সবুজ ডোরা, একটি শিয়াল, একটি শজারু, পাঁচটি লজ্জাবতী বানর, চারটি চশমা পরা হনুমান (একটি ইলেকট্রিক শকে), একটি বন্য শুকর ও দুটি ভাইপার। এদিকে গত বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত উদ্যানে গবেষণা করে দুই মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় বিভিন্ন প্রজাতির ৯৯টি প্রাণী মারা গেছে বলে জানায়। এ ছাড়া ২০১১ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অজগর সাপের ওপর গবেষণা করতে এসে গবেষকরা এক বছরে জাতীয় উদ্যানে ৩৫ প্রজাতীয় ৭০০ মরা সাপ দেখতে পান।

ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স এর প্রধান নির্বাহী ও সরীসৃপ গবেষক শাহরিয়ার সিজার রহমান বলেন, লাউয়াছড়ার মতো ছোট্ট একটি বনে ৪০ প্রজাতির মতো সাপ আছে। এ ছাড়া লাউয়াছড়া বনে বন ছাগলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই বনে ভাল্লুকসহ বিভিন্ন প্রজাতীয় প্রাণী রয়েছে। এখানে প্রাণীর বৈচিত্র্য অনেক বেশি কিন্তু সংখ্যায় খুব কম। এর মূল কারণ হিসেবে বন ধ্বংস করা বলে তিনি মনে করেন। বনের গাছ কাটা, বনের ভিতর সড়ক পথ, রেললাইন, অধিক মানুষের কোলাহল, বনের ছড়াগুলো শুকিয়ে যাওয়া সমস্যা থাকলে তো বন্যপ্রাণী থাকবে না। লাউয়াছড়ায় সাউন্ড করা যাবে না। কিন্তু পর্যটকরা গাড়িতে হিন্দি গান বাজিয়ে লাউয়াছড়া আসছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লাউয়াছড়াকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জন দেব বলেন, প্রাণীদের খাদ্য বনের বিভিন্ন গাছের ফল। আর ফল নেই তো প্রাণী নেই। বন উজাড়ের ফলে প্রাণীদের খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় প্রাণীরা বন ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে আসছে লোকালয়ে। বন কর্মকর্তারা বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংকটের বিষয়টি স্বীকার না করলেও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের উন্নয়নে দুই বছরে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে বন্যপ্রাণীর সহায়ক ২৫ হাজার দেশীয় জাতের বিভিন্ন ফলের চারা রোপণ করা হয়েছে বলে জানান। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দে বলেন, রেল ও সড়ক পথে প্রায়ই বন্যপ্রাণীরা মারা যাচ্ছে। অন্যান্য বন থেকে এ বনে অনেক বেশি বন্যপ্রাণী রয়েছে। এ ছাড়া দুর্লভ অনেক প্রাণীর আবাসস্থল লাউয়াছড়া। তাই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানকে অভায়াশ্রম ঘোষণা করা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর