শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ডায়াগনস্টিক সেন্টারই তৈরি করছে রোগ

মাহবুব মমতাজী

সারা দেশে অনুমোদিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ২৪ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা লক্ষাধিক। এ তথ্য খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের। তাই সংস্থাটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষাসংক্রান্ত অবৈধ ব্যবসা ঠেকাতে অক্টোবরের শেষ দিকে অনলাইন কার্যক্রম চালু করছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এ অনলাইনে দেশের সব বৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা দেওয়া থাকবে। যে কেউ অনলাইনে গিয়ে যে কোনো জেলা বা উপজেলার নাম লিখে সার্চ দিলেই দেখতে পাবেন সেখানকার অনুমোদিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামগুলো।

গবেষকরা বলছেন, মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কারণে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ভুল রিপোর্ট চলে আসে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী চিকিৎসকরা ওষুধ দেন। যদি রিপোর্টে যথাযথ রোগের তথ্য উঠে না আসে, তাহলে ভিন্ন রোগের ওষুধে রোগমুক্তির বদলে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করে। তারা জানান, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক. ভালোমানের মেশিন। দুই. মানসম্পন্ন রাসায়নিক এবং তিন. দক্ষ টেকনিশিয়ান।

অভিযোগ রয়েছে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় চিকিৎসকদের জন্য ৪০ শতাংশ কমিশন এখন ওপেন সিক্রেট। ব্যবসায়ীরাও এটি বিবেচনায় নিয়ে বেশি বেতনের ভালো কোনো টেকনিশিয়ান রাখেন না। তাদের প্রতিষ্ঠানে সাধারণ কর্মী দিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ সম্পন্ন করানো হয়। আর তাদের তালিকাভুক্ত চিকিৎসকের সিল মেরে দেওয়া হয় রিপোর্ট। এক চিকিৎসকের দেওয়া পরীক্ষার রিপোর্ট আরেক চিকিৎসকও গ্রহণ করেন না। তিনি পুনরায় পরীক্ষা করাতে বলেন। এর নেপথ্যেও রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। আর পৃথক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টও আসে ভিন্ন ভিন্ন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা প্রথম সন্তান জন্ম দেন ২০০৩ সালে। সে সময় তার শরীরের রক্তশূন্যতা পূরণের জন্য বোঁচাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বি-পজিটিভ রক্ত পুশ করা হয়েছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে পাঁচ দিনের জ্বরে আক্তান্ত হন তিনি। চিকিৎসকের পক্ষ থেকে তাকে রক্ত পরীক্ষা করাতে বলা হয়। তিনি দিনাজপুরের বোঁচাগঞ্জ উপজেলার জয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে জানানো হয়, তার রক্তের গ্রুপ এ-পজিটিভ। এ নিয়ে তার সঙ্গে বিতর্কও হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের। পরে ওই শিক্ষিকা অন্যত্র গিয়ে আবারও পরীক্ষা করান। গত ১৮ মে ভুল চিকিৎসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আফিয়া জাহিনের (২০) মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভাঙচুর করেন। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, আফিয়া মৃত্যুর ছয় দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। সেখানকার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আফিয়ার রক্ত পরীক্ষা করাতে বলা হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ওই রিপোর্ট অনুযায়ী একজন অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসক জানান, আফিয়া ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। সে অনুযায়ী ওষুধ দেওয়ায় হিতের বিপরীত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আসলে ওই চিকিৎসকের কোনো দোষ নেই। চিকিৎসকরা মূলত স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী রোগ নির্ণয় করেন এবং সে আলোকে ওষুধ দেন। আর আমাদের দেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেই তৈরি হচ্ছে নতুন রোগ। পরীক্ষায় ব্যবহূত জার্মানির মেশিন দেবে এক ধরনের রিপোর্ট, আর চায়না মেশিন দেবে আরেক ধরনের রিপোর্ট। এ অবস্থা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রেও।’ শুধু আফিয়াই নন, সারা দেশে এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা অসংখ্য। ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকার বাবর রোডের নিউ ওয়েলকেয়ার হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। ওই হাসপাতালের একটি কক্ষের জীর্ণ বিছানায় শুয়ে থাকা এক রোগীর দিকে এগিয়ে যান র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। রোগীর পায়ের কাছে দেখতে পান প্রেসক্রিপশনের মোটা একটি ফাইল। তাতে লেখা— রোগীর নাম খাদিজা বেগম। মাত্র ২০ দিন আগে ভর্তি হওয়া এই রোগীকে ওষুধ দেওয়া হয়েছে অন্তত ১০০ ধরনের। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে ১০টি করে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র গুনে পাওয়া যায় মোট ৬২ পাতা। ২৫ সেপ্টেম্বর মিরপুরের কয়েকটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালায় র‌্যাব-৪-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত। ভুল প্যাথলজিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট ব্যবহার করে, ভুয়া প্যাথলজিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট দেয় এবং অনুমোদন ও পরীক্ষা ছাড়াই রক্ত পরিসঞ্চালন করে। এ ছাড়া এক চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে আরেক চিকিৎসকের স্বাক্ষর দেখা যায়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আগামী মাসের শেষে আমরা যে কার্যক্রম হাতে নিচ্ছি, তাতে অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে র‌্যাব-পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হবে। ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোনো চিকিৎসক যদি নিয়োজিত থাকেন তাদের বিএমডিসি কোড সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনলাইনে লিপিবদ্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর