শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

শোচনীয় পুরান ঢাকা - ৪

মাহবুব মমতাজী

ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

পুরান ঢাকায় শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বাস করছেন হাজারো মানুষ। তাদের পরিবারের সংখ্যা কয়েকশ। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরাও এই ঝুঁকি থেকে বাদ যাচ্ছেন না। দেড়শ থেকে দুইশ বছরের পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ হেরিটেজ ভবনের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত থাকছেন ভবন ধসের আতঙ্কে। মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও সরকারি বিধি-নিষেধের কারণে ভবন সংস্কার করতে পারছেন না তারা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ভবন সংস্কারের অনুমতি চাইলেও তা পাওয়া যায় না। আবার সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা নেই। এমন পরিস্থিতিতে উভয় সংকটে রয়েছে সাধারণ পরিবারগুলো। এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িগুলোতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। কখনো কখনো ঘটছে প্রাণহানিও। সরেজমিন দেখা গেছে, কোর্ট-কাচারি পার হয়ে শাঁখারীবাজারে ঢুকতেই দুই পাশে শত বছর আগের বাড়ি-ঘর। প্রতিটি বাড়ির নিচে দোকান, আর উপরে রয়েছে পরিবারের বসবাস। শতাধিক বছরের পুরনো এসব বাড়ির দেয়ালের আস্তর অনেক আগেই খসে পড়েছে। অনেক বাড়ির ইটের গাঁথুনিও নড়বড়ে। দেয়ালে বড় বড় ফাটলের চিহ্ন বেশ স্পষ্ট। বৃষ্টি নামলেই দেয়াল বেয়ে পানি পড়ে ঘরের মেঝেতে। তবু উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি নন বাসিন্দারা। হেরিটেজ সংরক্ষণের অভাব এবং পুনঃসংস্কারের যথাযথ নীতিমালা না থাকায় ঝুঁকির মধ্যেই বাস করছেন তারা। ফরাশগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রূপলাল হাউসটিও এখন চরম ঝুঁকিতে। ভবনটির দোতলায় বিজিবি ও আনসার সদস্যরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। সূত্রাপুরের ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো ভবনের মধ্যে রয়েছে, ২৬ নম্বর বি কে দাস রোডের বাড়ি। ৭, ৪০, ২২, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ১২/১, ৫৯ ও ৬২ নম্বর বাড়িগুলো। এসব বাড়ির নিচের তলায় চলে ছাপাখানার কাজ, আর উপরে বসবাস। বি কে দাস রোডের ৬৫ নম্বর দৃষ্টিনন্দন বাড়িটিতে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যেও চলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। কিছু অংশে পরিবার আছে। কালীচরণ সাহা রোডের তিনশ বছরের পুরনো মিল ব্যারাকটিও রয়েছে ঝুঁকিতে। ১৭ নম্বর সূত্রাপুর কাঁচাবাজার রোডের বাড়িটিও দীর্ঘদিন ধরে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। ঝুঁকিমুক্ত নয় ডালপট্টির আর এম দাস রোডে অবস্থতি সূত্রাপুর ফায়ার স্টেশনও। এখানকার নাজুক একটি দোতলা ভবনে ১০ জন কর্মী নিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম। হাবিবুর রহমান নামে এক ফায়ারম্যান এ প্রতিবেদককে বলেন, এ ভবনের পাশেই আমাদের জন্য আরেকটি নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। শিগগিরই সেখানে সব কার্যক্রম স্থানান্তর করা হবে। বিপ্লব সাহা নামে শাঁখারীবাজারের এক বাসিন্দা বলেন, প্রতিদিনই ভবনের গা থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। এরই মধ্যে ভবনের কিছু অংশ ধসে পড়েছে। সংস্কারের অনুমতি চেয়েও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে অনুমতি পাওয়া যায়নি। সর্বোপরি আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে আছি। ১০ নম্বর লেনের আরেক বাসিন্দা বিমল বিশ্বাস জানান, প্রায় দেড়শ বছর আগে তার দাদা প্রাচীন এ বাড়িটি কিনেছিলেন। বংশপরম্পরায় তারা পাঁচভাই এ বাড়িতেই বাস করছেন। তাদের নিজেদেরও সামর্থ্য নেই বাড়ি সংস্কারের। আবার আইনি জটিলতায় তারা ডেভেলপারকেও দিতে পারছেন না।  জানা গেছে, ২০০৪ সালে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারের একটি ভবন ধসে ১৯ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর রাজউক, বুয়েট, ঢাকা সিটি করপোরেশন কারিগরি জরিপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও ঐতিহ্যবাহী ভবন শনাক্ত এবং তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে ঢাকায় শতাধিক হেরিটেজ ভবনকে শনাক্ত করা হয়। রাজউক ঋষিকেশ দাস রোড, রেবতিমোহন দাস রোড, বি কে দাস রোড, ফরাশগঞ্জ রোড, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, পানিতলা, প্যারিদাস রোড ও হেমন্ত দাস রোডের নাম হেরিটেজের তালিকাভুক্ত করে। ২০১১ সাল থেকে জাইকার সহযোগিতায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদফতর পরিচালিত চার বছর মেয়াদি আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে নির্মিত ঢাকার ২ হাজার ১৯৩টি সরকারি ভবনের ৫৯ শতাংশই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মো. আজিম বকস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে সরকারি স্বদিচ্ছা না থাকলে কিছুই হবে না। সরকারি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক ভবনকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেরই ভবন সংরক্ষণ কিংবা ঝুঁকিমুক্ত করার সামর্থ্য নেই। অথচ সরকারও সরকারি ভবনগুলোই ঝুঁকিমুক্ত করছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর