শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মাদকবিরোধীরাই এলাকাছাড়া

সাঈদুর রহমান রিমন

মাদকবিরোধীরাই এলাকাছাড়া

মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর খিলগাঁও থানা এলাকায় মাঝে মাঝেই ঘটছে তুলকালাম কাণ্ড। একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদক ব্যবসায়ীরাই হয়ে উঠেছে সর্বেসর্বা। মাদকবিরোধীদের হামলা-মামলায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন মাদকবিরোধী আন্দোলনকারীরা। মাদকবিরোধী প্রচার-প্রচারণা, মিছিল-র‌্যালি, সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের বাড়িঘরে হামলা চালানো, মারধর করাসহ বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে এরই মধ্যে এলাকাছাড়া করা হয়েছে। মাদকবিরোধী আন্দোলনের মূল নেতাসহ অন্তত ১০ জনকে গ্রেফতার করে জেলেও পাঠিয়েছে পুলিশ। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা বুক ফুলিয়ে দাপটের সঙ্গে বিচরণ করছে, তাদের মাদক স্পটগুলোও পরিণত হয়েছে খোলামেলা হাট-বাজারে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, খিলগাঁও থানার সর্বত্রই মাদকে ভাসছে। দশটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের আওতায় তিন শতাধিক ব্যবসায়ী খিলগাঁওজুড়ে রমরমা মাদক বাণিজ্য চালাচ্ছে বাধাহীনভাবে। তারাই পরিচালনা করছে ৫৭টি মাদক স্পট। প্রতিদিন সাড়ে তিন লাখ টাকা বখড়ার বিপরীতে পুলিশ মাদক ঘাঁটিগুলো নির্বিঘ্ন রাখার অলিখিত দায়িত্ব পালন করে থাকে। প্রশাসনের প্রশ্রয় থাকায় খিলগাঁওয়ের মাদক বাণিজ্য দিন দিনই বেপরোয়া রূপ পেয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, মূলত মাদক ব্যবসাকে ঘিরেই অন্য সব অপরাধের বিস্তার ঘটছে খিলগাঁওয়ে। মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে থাকা পুলিশ সোর্সরাই ম্যানেজ করছে সব ঘাট। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, পুলিশের চিহ্নিত ২০ জন সোর্সই দৈনিক প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদক বাণিজ্য সচল রাখে।

মাদকবিরোধীরা এলাকাছাড়া : সম্প্রতি মাদক ব্যবসাসহ অসামাজিক কার্যকলাপের দৌরাত্ম্য রুখতে গড়ে ওঠে জনমত, শুরু হয় সামাজিক আন্দোলন। স্থানীয় যুবলীগ নেতা আবদুল আজিজের নেতৃত্বে মাদকবিরোধী প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, থানা ঘেরাওসহ নানা আন্দোলন কর্মসূচি চলছিল। ওই সময় বেশ কয়েকটি মাদক আখড়া উচ্ছেদ করার ঘটনাও ঘটে।

ধারাবাহিক আন্দোলনের মুখে মাদকের খোলামেলা বেচাকেনায় ভাটা পড়ে, শঙ্কিত হয়ে ওঠে মাদক ব্যবসায়ীরা। তারাও চাঁদা তোলে তহবিল গঠন করে মাদকবিরোধীদের দমাতে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা কতিপয় পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) টিম নিয়ে আন্দোলনকারীদের বাড়ি বাড়ি চড়াও হচ্ছেন। এ চক্রের কথিত চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার করা হয় মাদকবিরোধী আন্দোলনের নেতা আবদুল আজিজসহ অন্তত ১০ জনকে। জামিনে বেরিয়ে আসতেই পুলিশের উপস্থিতিতে মাদক ব্যবসায়ীরা আজিজের ওপর হামলা চালায় এবং বেধড়ক কুপিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠায়। এ ঘটনার ১০ দিন পরও পুলিশ কোনো মামলা রেকর্ড না করায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা মাদকবিরোধী পোস্টার ও ব্যানার টানানোর অপরাধে (!) জহিরুল ইসলাম সাফিন নামে এক তরুণকে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহতও করেছে। মাদকবিরোধী মিছিল-র‌্যালি ও মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়ায় তালতলা এলাকার মোহর আলীকে মাদক ব্যবসায়ীরা এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে এবং মনির হোসেন নামে আরেক যুবকের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। মাদকবিরোধী আন্দোলনকারী দক্ষিণ বনশ্রীর সুজন শেখ, খিলগাঁও সি ব্লকের মাইনুল হাসান, মো. কবির, সিপাহিবাগের সোহেল হাওলাদার, মামুন হাওলাদার, মেরাদিয়ার মো. শুভ, তিলপাপাড়ার জহিরুল ইসলাম, তালতলার মনির হোসেন, রাসেল, সাকিল দফায় দফায় মাদক ব্যবসায়ীদের হামলা ও পুলিশি হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ ছাড়াও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ তিলপাপাড়ার শাহীন, আবদুর রহমান, গোড়ানের চঞ্চল, আলী হোসেন, মোমিন খানসহ খিলগাঁও এলাকার বেশ কয়েকজনের বাড়ি চড়াও হয়ে নানারকম হুমকি-ধমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের হুমকি-ধমকি, হয়রানি-নির্যাতনের অজানা শঙ্কায় এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মাদকবিরোধীরা। ফলে ফের মাঠ দখল করে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা, আবার সচল হয়েছে মাদক কেনাবেচার খোলামেলা হাট-বাজার।

মাদকের যত ঘাঁটি : খিলগাঁও থানা এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে ১০টি প্রধান সিন্ডিকেট। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের এসব সিন্ডিকেটে রয়েছে তিন শতাধিক নারী-পুরুষ। তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে ইয়াবা, ফেনসিডিল, পেথিডিন, গাঁজার ৫৭টি স্পট খুলে বসেছে। খিলগাঁও থানাসংলগ্ন পূর্ব পাশে ২০০ গজের মধ্যেই তিনটি মাদক স্পট আছে। স্পট তিনটি নিয়ন্ত্রণ করে ফরমা খালেক, রাজিব ও ডিবি সোর্স খোকন ওরফে তাপস।  খিলগাঁও ভূইয়ার ঝিলপাড়ে ফেনসিডিল ও ইয়াবার স্পটটি নিয়ন্ত্রণ করে বেদেনা ও নাইট গার্ড খায়ের। খিলগাঁও সি ব্লকে দুটি বড় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে জেনারেটর রিপন ও নেসার সিন্ডিকেট। সি ব্লকে তছলিম-সাধুর সিন্ডিকেটটি হচ্ছে মাদকের সবচেয়ে প্রতাপশালী। পুরো সি ব্লক জুড়ে ত্রিশটিরও বেশি সিসি ক্যামেরা বসিয়ে আলাদা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। সিপাহিবাগের কবরস্থান গলি, মদন গলি ও আইসক্রিম গলির মাদক বাজার পরিচালনা করে নূর মোহাম্মদ সিন্ডিকেট। গোড়ানে কসাই বাবুল-নেতা সাইফুল সিন্ডিকেট। গোড়ান ৮ নম্বর গলির মাদক ব্যবসা চালাচ্ছে জুয়েল, সোহেল, রুবেল নামের তিন সহোদর। ত্রিমোহনীতে বড় আকারের স্পটটি নিয়ন্ত্রণ করে জিন্নাহ, মনির, ডাকাত জলিল, মাইনুদ্দিন, জাহাঙ্গীর এবং নন্দীপাড়া ৬ নম্বর রোডে লাঙ্গল বাবু-রনি সিন্ডিকেটের মাদক ব্যবসা চলছে বাধাহীনভাবে।

ভিডিও ফুটেজেই বেজে ওঠে অ্যালার্ম : রাজধানীর খিলগাঁও থানা ঘেঁষেই রাজিবের মাদক স্পট। সেখানে রাত-দিন চলছে ইয়াবা, ফেনসিডিল আর গাঁজা বেচাকেনা। থানা ভবনে দাঁড়িয়েই রাজিবের স্পটে মাদক কেনাবেচা ও নেশার দৃশ্যাবলি দেখতে পান পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু এসি, ওসির নির্দেশ না থাকায় সেখানে অভিযান চালাতে সাহস করেন না থানা পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা। মূল হোতা রাজিবের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রুজু আছে। তাকে কয়েক দফা গ্রেফতার করে জেলে পাঠালেও থামানো যাচ্ছে না তার কর্মকাণ্ড। সূত্র বলছে, কুমিল্লার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল ও চট্টগ্রাম এবং টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে হাজার হাজার পিস ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকসহ গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্স ও বিলাসবহুল গাড়িতে খিলগাঁওয়ে পৌঁছায়। সেগুলো নামানো হয় খিলগাঁও থানার পাশেই ফরমা খালেক ও রাজিবের মাদক আস্তানায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আসার খবরে বেজে ওঠে সেই অ্যালার্ম। সঙ্গে সঙ্গে গোপন পথে পালিয়ে যায় মাদক বিক্রেতারা। সম্প্রতি খিলগাঁও শান্তিপুরের ৫ নম্বর গলিতে বেদেনার মাদক আস্তানায় অভিযানকালে অ্যালার্ম বাজিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের পালানোর দৃশ্য অভিযানকারীদেরও অবাক করে।

সোর্স পরিচয়ে বখড়া আদায় : খিলগাঁও থানা পুলিশ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট জোন কর্মকর্তার নামে তারা সাপ্তাহিক ও দৈনিক হারে বখড়া আদায় হচ্ছে। থানার নামে প্রতিটি স্পট থেকে দৈনিক দুই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত এবং মাদকের জোন কর্মকর্তার নামে একেকটি স্পট থেকে সপ্তাহে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। তবে খিলগাঁও জোনে দায়িত্বরত মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইন্সপেক্টর সুমনুর রহমান জানান, মাদক কর্মকর্তার নামে মাসোয়ারা চালু রাখার কোনো সুযোগ নেই সেখানে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে খিলগাঁও জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার নাদিয়া জুঁই বলেন, প্রায় প্রতিদিনই খিলগাঁওয়ের কোথাও না কোথাও মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। মাদক দ্রব্য উদ্ধারসহ মাদক ব্যবসায়ীদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। সেখানে কেউ কাউকে মাসোয়ারা দিয়ে পার পাচ্ছে না।

 

সর্বশেষ খবর