শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

তিন রোগের মরণ কামড়

মৃত্যু বাড়ছে হার্ট, ক্যান্সার ও কিডনি রোগে

শিমুল মাহমুদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

দেশে প্রতিদিন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। এর সিংহভাগই আক্রান্ত হার্ট, ক্যান্সার ও কিডনি রোগে। এসব দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসায় হাজারো নতুন প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটলেও বাগে আসছে না অসুখ। দেশে বর্তমানে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ এবং কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। এ ছাড়া হৃদরোগে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে প্রায় ৮৯ হাজার মানুষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর অসংক্রামক ব্যাধিতে মৃত্যু হয় ৫ লাখ ২৩ হাজার বাংলাদেশির। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ মানুষ মারা যায় হার্ট, কিডনি, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন অসংক্রামক ব্যাধিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও সেবা প্রদান করা হচ্ছে। হার্ট, ক্যান্সার ও কিডনি রোগ প্রতিরোধে নেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ। এসব রোগ নিরাময়ে উন্নতমানের চিকিৎসার পাশাপাশি গবেষণায়ও জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে রোগীর তুলনায় আমাদের জনবল ও অবকাঠামো খুবই কম।’

ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে : দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সারের কারণে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ তা ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে প্রতি বছর ১ লাখ ২১ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে আর মৃত্যুবরণ করছে ৯১ হাজার। কিন্তু রোগের প্রকোপ এবং রোগীর সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসার অবকাঠামো ও জনবল বাড়ছে না সে তুলনায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ১০ লাখ জনের জন্য একটি রেডিওথেরাপি চিকিৎসা কেন্দ্র প্রয়োজন। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৬ কোটি  মানুষের জন্য প্রয়োজন রেডিওথেরাপি মেশিন ও প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলসংবলিত ১৬০টি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র। অথচ দেশে মহাখালীর ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেলসহ মাত্র কয়েকটি বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে এ চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতালেই রেডিওথেরাপি চিকিৎসার মেশিনই নেই। দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা অপ্রতুল। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১৫টি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মাধ্যমে বছরে মাত্র ৫০ হাজার রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব। বাকি প্রায় ১ লাখ রোগীর অধিকাংশই অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে হয় চিকিৎসাবঞ্চিত, নয় তো অপচিকিৎসার শিকার হন। সারা দেশে এ-সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদের সংখ্যা মাত্র ৮৫। একই সঙ্গে প্রতি ৩ হাজার রোগীর জন্য একটিমাত্র শয্যা বিদ্যমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর দেশে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৯০ হাজার ৭০০ জন ক্যান্সারে মারা যান। এ সংখ্যা ওই বছরের মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশেরও বেশি।

ব্রেস্ট ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক রেডিওলজিস্ট ও ক্যান্সার হাসপাতালের ক্যান্সার এপিডিমিয়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায় দক্ষতা, কাঠামো ও জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। পাঁচটি বিষয় খেয়াল রাখলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। তামাক ও অ্যালকোহল পরিহার, আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করা, বাল্যবিয়ে বন্ধ করা এবং অতিরিক্ত চর্বি, প্রাণিজ আমিষ ও অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করা। এর সঙ্গে পাঁচটি বিষয়ে জোর দিতে হবে আঁঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, কায়িক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করা, শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানো, পরিচ্ছন্ন থাকা, সঠিক সময়ে রোগ প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করা। রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানাতে প্রচার বাড়ানোর আর লক্ষণ দেখা দিলে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কিডনি রোগী : কিডনি রোগীর সংখ্যাও প্রতি বছরই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। একদিকে কিডনি প্রতিস্থাপনসহ এর চিকিৎসায় নতুন পদ্ধতি আসছে আর অন্যদিকে বাড়ছে রোগী। দেশে বর্তমানে কিডনি রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন ও বিএসএমএমইউ সাভারের চাকুলিয়া গ্রামে তিন বছর ধরে কতজনের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ রয়েছে এর ওপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ৩ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ওপর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা প্রায় ১৮ ভাগ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে শতকরা ১৩ ভাগ রোগীর রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে ওপরে। অর্থাৎ তাদের কিডনির কার্যকারিতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। সমীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়, বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছেন। আর প্রতি বছর এ রোগের কারণে মারা যাচ্ছেন প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। কিডনি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে মারা যাচ্ছেন তারা। এই ঊর্ধ্বহারে কিডনি অকেজো হওয়ার কারণ হিসেবে নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপকেই দায়ী করা হয়। নেফ্রাইটিস রোগের প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন, ভাইরাল হেপাটাইটিস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। খাবারে রাসায়নিক পদার্থ মেশানো এবং ভেজাল ও ক্রনিক ইন্টারস্টেশিয়াল নেফ্রাইটিস এর কারণ হিসেবে দায়ী। পানিতে অধিক পরিমাণে আর্সেনিকও কিডনি রোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস, এইচআইভি ভাইরাস দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের একটি বড় কারণ। ঠিক তেমনি ম্যালেরিয়া আফ্রিকা মহাদেশে কিডনি রোগের কারণ হিসেবে বিবেচিত।

কিডনি ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. হারুন আর রশিদ বলেন, বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। গ্রাম ও শহর পর্যায়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ের চলমান গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৮ শতাংশ। কিন্তু ৬০ শতাংশ রোগী জানেনই না যে তাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয়। ফলে তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হননি। এ কারণে তাদের কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এই রোগীগুলোকে শনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

মৃত্যুঝুঁকিতে হৃদরোগে আক্রান্তরা : বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। এর সংখ্যা ৩১ শতাংশ। আর এ সংখ্যা হিসাব করলে ২০৩০ সাল নাগাদ ২৩ মিলিয়ন লোক হৃদরোগে মারা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশি মারা যাবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোয়। ভৌগোলিক অবস্থান, চর্বিযুক্ত খাবার বেশি গ্রহণ, তামাক ব্যবহার ও জীবনযাত্রা পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মানুষ এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। বাতজ্বরের কারণেও অনেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া উচ্চতার কারণে করোনারি সরু থাকে, যা তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। কারও করোনারির ৭০ শতাংশ ব্লক হলে বুকে ব্যথা, চাপ অনুভব করা ও দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, কারও যদি ১০০ শতাংশ ব্লক হয়ে যায়, তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। একটা সময় ছিল, যখন বয়স্ক (৬০ থেকে ৭০ বছর) লোকদের হার্ট অ্যাটাক হতো। ইদানীং ২৫-৩০ বছর বয়সীদেরও হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের কেন এটি হচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০১৬ সালের হেলথ বুলেটিনে বলা হয়েছে, রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজে (এনআইসিভিডি) প্রতি বছরই হৃদরোগ আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির বহির্বিভাগে ২০১৫ সালে ২ লাখ ২২ হাজার ১৮৬ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৬৩ হাজার ৩৯০ জন ভর্তি হয়েছেন। এর আগের বছর ২০১৪ সালে ২ লাখ ৫৫৩ জন আউটডোরে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৪৯ হাজার ২৮৩ জন ভর্তি হয়েছেন। এর আগের বছর ১ লাখ ৭২ হাজার ২৬৯ রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৪৩ হাজার ৩৪১ জন ভর্তি হয়েছেন। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছরই হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে সে অনুযায়ী বাড়ছে না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, দক্ষ টেকনিশিয়ান ও চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির মহাসচিব আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রতি পাঁচজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। আর ১২ শতাংশ মানুষ হার্টফেইলরে আক্রান্ত হয়। তবে বয়সভেদে কম-বেশি হতে পারে। এ দুটি বিষয়ে সচেতন না থাকায় বাড়ছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা। হৃদরোগে চিকিৎসা মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। অন্য জায়গায় থাকলেও তা খুবই কম। রাজধানীতে ২২টি কেন্দ্রে হৃদরোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৮-১০টি হাসপাতাল সার্বক্ষণিক সেবা দিতে পারলেও বাকিগুলোয় নেই জরুরি বিভাগ। কিন্তু হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষকে বাঁচাতে সবচেয়ে প্রয়োজন হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। কারণ হার্ট ফেইল করার ৯০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে রিকোভারি সেবা দিতে পারলে হার্টের ক্ষতি রোধ করে রোগীকে বাঁচানো যায়। এর বেশি সময় পার হলে রোগীর জীবননাশের ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই হৃদরোগের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে হাসপাতালে জরুরি সেবার পাশাপাশি মানুষকে রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর