শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১১২

জুয়েলারি কার্ডে খুনির পরিচয়

মির্জা মেহেদী তমাল

জুয়েলারি কার্ডে খুনির পরিচয়

‘হ্যালো, মতিঝিল থানা ডিউটি অফিসার বলছি। কে বলছেন প্লিজ। ... কোন হোটেল? ফকিরাপুলের আল শাহিন? আচ্ছা। ফোর্স পাঠাচ্ছি।’ ল্যান্ড ফোনে কথা শেষ করেই ডিউটি অফিসার ওয়্যারলেসে মেসেজ পাঠান। ইমারজেন্সি অফিসার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. সবির উদ্দিন শিকদার মধ্যরাতে থানার মেসেজ পেয়েই ছুটে যান সেই আবাসিক হোটেলে। হোটেলের একটি কক্ষের সামনে তখন কর্মচারীদের ভিড়। পুলিশের উপস্থিতিতে তারা সরে দাঁড়ায়। পুলিশ জানতে পারে, ওই কক্ষে এক দম্পতি রয়েছে। তাদের সঙ্গে ১৫/২০ দিনের একটি নবজাতকও রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও দরজা খোলেনি। ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া মিলছে না। পুলিশ এবার দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। কিন্তু ভিতরে কোনো শব্দ নেই। পুলিশের সন্দেহ হয়। সন্দেহ থেকেই দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত। লোকজন নিয়ে ওই কক্ষের দরজা ভাঙে পুলিশ। অন্ধকার। ভিতরে কটু গন্ধ। আলো জ্বালাতেই আঁতকে উঠে পুলিশ!  মেঝেতে পড়ে আছে অষ্টাদশী নারীর লাশ। গলায় ওড়না বাঁধা। কয়েকটি গিঁট দেওয়া। হোটেলের মালিক আর কর্মচারীরা ওই নারীকে শনাক্ত করে। তারা জানায়, এই নারীর সঙ্গে একজন পুরুষ ছিলেন। ছিল ১৫/২০ দিনের একটি শিশুও। আগের রাতে হোটেলে এসে তাড়াহুড়া করে তারা রুম নেয়। ক্লান্ত থাকায় রুমে গিয়ে নাম ঠিকানা লিখে দিবে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পার হলেও তারা রুম খোলেননি। এমন কথা শুনে পুলিশ বিরক্ত হোটেল কর্তৃপক্ষের ওপর। নাম-ঠিকানা জানে না বলায়, পুলিশের সন্দেহের তীর হোটেল মালিক আর কর্মচারীদের দিকে। পুলিশ এও ভাবছে, যদি তাই হয়, তাহলে সেই পুরুষ বা শিশুটি গেল কোথায়? পুলিশ ওই কক্ষটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ওই কক্ষ থেকে পুলিশ চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী রুটের বাসের দুটি টিকিট ও জুয়েলারি দোকানের একটি কার্ড পায়। এ দুটি জিনিস পুলিশ যত্ন সহকারে গুছিয়ে নেয়। কারণ, এ দুটি ছাড়া আর কিছুই ওই কক্ষ থেকে পাওয়া গেল না।

মেঝে থেকে পুলিশের চোখ যায় খাটে। খাটের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয় পুলিশ। হঠাৎ চোখ আটকে যায় খাট আর দেয়ালের মাঝের ফাঁকে। শিশুর মাথার মতো লাগছে! পুলিশ কর্মকর্তা লাফিয়ে খাটে উঠে বসে। সেই ফাঁকে চোখ রাখে। হ্যাঁ, সন্দেহ ঠিক। ১৫/২০ দিনের সেই শিশু। পুলিশের বুক কাঁপে। এতটুকু একটি বাচ্চাকেও রেহাই দেওয়া হলো না! শিশুটির কী অপরাধ? পুলিশ শিশুটিকে সেখান থেকে তুলে খাটের ওপর রাখে। তার শরীরে ক্ষতের চিহ্ন। পুলিশ বুঝতে পারছে না, শিশু ও নারীর সম্পর্কটা কী। সেই পুরুষটাই বা কে? তবে ধারণা করে নিয়েছে পুলিশ, এই নারীর সন্তান হতে পারে শিশুটি। আর সেই পুরুষটি এই নারীর স্বামী। খুনের সঙ্গে সে জড়িত বলেও পুলিশের ধারণা প্রবল।

মাথায় যখন এমন নানা কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক তখনই ঘটে ঘটনাটা। শিশুটির একটি হাতের আঙ্গুল নড়াচড়া করছে। এমন দৃশ্যে পুলিশ ভেবাচেকা খায়। গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। হ্যাঁ, আবারও নড়ছে আঙ্গুল। তার মানে বেঁচে আছে শিশুটি। সব কাজ ফেলে পুলিশ আগে সেই শিশুটিকে নিয়েই দেয় ছুট। সোজা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

এদিকে নারীর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি হয়। পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। তদন্ত শুরু করে পুলিশ। কিন্তু কী নিয়ে তদন্ত করবে পুলিশ? এ নিয়ে চিন্তার যেন শেষ নেই পুলিশের। ঘটনাটি চলতি বছরের মে মাসের।

তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে ২১ মে রাত প্রায় সাড়ে ৩টার দিকে এই দম্পতি হোটেলে আসেন। তাদের কোলের নবজাতকটি তখন কাঁদছিল। হোটেলের খাতায় নাম-ধাম না লিখে দ্রুত কক্ষে চলে যান। হোটেলের কর্মচারীরা দেখতে পান এ কক্ষের দরজা কেউ খুলছেন না। পরদিন রাতে পুলিশ ডাকা হয়। যে কক্ষে মৃতদেহ পড়ে ছিল, সেখানে তাদের পরিচয় শনাক্ত করার মতো তেমন কোনো সূত্র নেই। তবে কক্ষে থাকা একটি ভ্যানেটি ব্যাগে চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী আসার বাসের টিকিট আছে, কিন্তু যাত্রীর নাম নেই। আর আছে লক্ষ্মীপুরের রামগতির একটি জুয়েলারির কার্ড, একটি কাগজে লেখা ফোন নম্বর। ব্যাস, এটুকুই। লাশের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে ভোটার তালিকার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাও মেলেনি। পুলিশের ধারণা, এই নারী জাতীয় পরিচয়পত্র করেননি। তার সঙ্গে যে যুবক ছিলেন, তারও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার মাথায় তখন নানা কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি ভাবলেন, যা কিছু করতে হবে, এই জুয়েলারি কার্ডের মাধ্যমেই। আর কিছু যে নেই তার হাতে। তিনি জুয়েলারির কার্ডটি নিয়ে লক্ষ্মীপুরের রামগতির সেই দোকানটি খুঁজে বের করেন। তিনি সেখানে গিয়ে কথা বলেন। কিন্তু লাভ হলো না কিছু। কার্ডে নাম-ধাম নেই বলে চিনতে পারল না জুয়েলারি কর্তৃপক্ষ। পুলিশ এরপর সেই নারীর লাশের ছবি দেখায়। হয়তো এতে কাজ হবে। পুলিশের কর্মকর্তা উত্তেজনায় রয়েছে। কিন্তু লাশের ছবি দেখেও চিনতে পারল না কেউ। ব্যর্থ পুলিশের অভিযান। পুলিশ সেই ছবিটি দোকানে ঝুলিয়ে রাখতে বলে দিল। মালিককে বলা হলো, এটা যেন সব খদ্দেরকে দেখানো হয়। পুলিশ চলে আসে ঢাকা। হয়তো এই রহস্যের কূলকিনারাই আর হবে না। পুলিশ এবার ফকিরাপুলের সেই হোটেলের মালিক আর কর্মচারীদের ধরে নিয়ে যায়। তাদের জেরা করা হয়। কিন্তু দিনের পর দিন পেরিয়ে যায়, তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য মিলে না। পুলিশ প্রায় নিশ্চিত হয় যে, এই ঘটনায় মালিকপক্ষের কেউ জড়িত নয়। এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সেই নবজাতক সুস্থ হতে থাকে। চিকিৎসক আর নার্সদের পরম যত্নে প্রাণ ফিরে পায় শিশুটি।

হোটেলে নারীর লাশ উদ্ধারের ঘটনার তদন্ত আর এগোয় না। এক রকম থমকে আছে তদন্ত। ঘটনার ২১ দিন পর হঠাৎ একটি ফোন আসে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। অজ্ঞাত ওই ব্যক্তিটি নিহত নারীর আত্মীয় পরিচয় দেন। পুলিশ এমন কোনো খবরের অপেক্ষাতেই ছিল।

নারীর লাশের ছবি রামগতির সেই জুয়েলারি দোকানের খদ্দেরদের দেখাতে গিয়ে পরিচয় মিলে একজনের। এক নারী ছবিটি দেখে চিনে ফেলেন নিহত নারীকে। ওই নারী খবর দেন নিহত নারীর পরিবারকে। পরে নিহত নারীর পরিবার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তথ্য পেয়ে পুলিশ খুনের রহস্য উন্মোচন করে।

পুলিশ জানতে পারে, নিহত নারীর নাম রিনা আক্তার (২০), বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে। জীবিত উদ্ধার হওয়া নবজাতকটি তারই মেয়ে। তার স্বামীর নাম টিপু সুলতান (২৫)। শিশুটির বাবা। বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। তিনি চট্টগ্রাম নগরে একটি দোকানে কাজ করেন, আর তার স্ত্রী রিনা চট্টগ্রামে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। গোপনে পোশাককর্মী রিনাকে বিয়ে করেন টিপু। পরিবার সেই বিয়ে মেনে নেয়নি। তাই স্ত্রীকে হত্যা করে নবজাতককে রেখে টিপু পালিয়ে যান।

রিনার পরিবার খুবই দরিদ্র। সাড়ে তিন বছর আগে চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন তিনি। সেখানে দোকানের কর্মচারী টিপুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর তাকে বিয়ে করেন। অন্তঃসত্ত্বা হন রিনা। তিনি স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বাবার বাড়ি রামগতি যান। সেখানে তার সন্তানের জন্ম হয়। এরপর ১৭ মে রিনাকে সেখান থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যান টিপু। এরপর থেকেই রিনার পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। পরে ওই জুয়েলারি দোকানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানতে পারে রিনা খুন হয়েছে। তাদের কাছ থেকে টিপুর বিষয়ে তথ্য নেয় পুলিশ। চট্টগ্রামে টানা দুই দিন অভিযান চালানো হয় বিভিন্ন স্থানে। অবশেষে সন্ধান মিলে সেই খুনির। গ্রেফতার হয় রিনার খুনি টিপু সুলতান। তিনি খুনের সব ঘটনা স্বীকার করে নিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর