শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

দলের ক্ষুব্ধ নেতারা গর্ত খুঁড়তে পারেন শাহরিয়ারের পথে

রাজশাহীতে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি - শেষ

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে দীর্ঘ অপেক্ষা, স্কুলে গিয়ে শিশুদের ক্লাস নেওয়া, সমসাময়িক নানা ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তার নির্বাচনী এলাকার নেতাদের অভিযোগ, নিজের ব্যবসা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যতটা সক্রিয় তিনি, এর ছিটেফোঁটাও সক্রিয় নন সাংগঠনিক কাজে।

তার সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সেখানে উদ্ভব হয়েছে উপদলীয় কোন্দল। গড়ে উঠেছে অঞ্চলভিত্তিক নেতা। তাদের কর্মকাণ্ডে প্রায় বিব্রত শাহরিয়ার আলম। শাহরিয়ার আলমের প্রশ্রয়ে সেখানে নানা অনিয়ম চালু রেখেছে দলের একটি অংশ। আর একটি অংশ আগামীতে মনোনয়ন পেতে মাঠে। ফলে আগামী নির্বাচনে এসব নেতার তৎপরতায় ডুবতে পারে শাহরিয়ারের নৌকা।

চারঘাট ও বাঘা উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত রাজশাহী-৬ সংসদীয় আসন। এ আসনটি বরাবরই ছিল বিএনপির দখলে। ধানের শীষের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসন এলাকায় ২০০৮ সালে নৌকার গণজোয়ারের মধ্যে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন শাহরিয়ার আলম। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তাকে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিপক্ষে। এর আগে সবগুলো নির্বাচনে চারঘাট-বাঘা আসনে বিএনপিই জিতেছে। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার আনন্দে সুখনিদ্রার সুযোগ নেই শাহরিয়ার আলমের। জনপ্রিয়তার দিক থেকে চারঘাট ও বাঘায় নিজ দলের সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেও ভোটের মাঠে বিএনপিকে অনায়াসে টপকে যাওয়ার মতো অবস্থান এখনো তৈরি করতে পারেননি তিনি। দলের ভিতরে তার বিপক্ষে অবস্থান করছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু, সাবেক এমপি রায়হানুল হক। হালে সেই তালিকায় যোগ হয়েছেন বাঘা পৌরসভা নির্বাচনে পরাজিত আক্কাস আলী। আক্কাস আলী বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হন। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে শাহরিয়ার আলম সাবেক উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বাবুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করেন। এর ফলে শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে আক্কাস আলীর দূরত্ব বাড়ে। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর বাঘা পৌর নির্বাচনে আক্কাস আলীর পক্ষে শাহরিয়ার আলমের কয়েকজন আস্থাভাজন নেতা মাঠে কাজ না করায় তিনি পরাজিত হয়েছেন বলে অভিযোগ আক্কাস আলীর। আক্কাস আলীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডও শাহরিয়ার আলমকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে। পৌর মেয়র থাকাকালীন আক্কাস আলী নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এর পেছনে শাহরিয়ার আলমের ইন্ধন আছে বলে চাউর হয়। অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু শাহরিয়ার আলম উপজেলা নির্বাচনে সমর্থন দেন মিজানুর রহমান মিনুকে। ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হন। ওই পরাজয়ের পর থেকে লায়েব উদ্দিন লাভলু তার বিপক্ষে আছেন। চারঘাট পৌরসভার মেয়র নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নার্গিস খাতুনের বিপক্ষে অবস্থান নেন প্রতিমন্ত্রী ও তার লোকজন। এ কারণে ক্ষুব্ধ সাবেক এমপি রায়হানুল হক। নার্গিস খাতুন হলেন রায়হানুল হকের স্ত্রী। আগে মেয়র থাকলেও দলীয় মনোনয়ন পেয়ে পরাজিত হন নার্গিস খাতুন। এই পরাজয়ের নেপথ্যে শাহরিয়ার আলম বলে দাবি রায়হানুল হকের। রায়হানুল হক জানান, এমপির কারণে দলীয় প্রার্থী এখানে পরাজিত হয়েছেন। তার ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া বিপ্লব বিদ্রোহী প্রার্থী হন। বাঘার  চাকরাজাপুর ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন বাবলু দেওয়ান। তার বিপরীতে প্রার্থী হন আজিজুল আযম। অভিযোগ আছে, ওই নির্বাচনে শাহরিয়ার আলম ও তার লোকজন দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বাবলু দেওয়ান পরাজিত হন। এ ছাড়া চারঘাট উপজেলায় বিএনপি ও বাঘায় জামায়াত প্রার্থী উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী হন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, ২০০৮ সালে যারা নৌকার বিরোধিতা করেছিল, ২০১৪ সালেও তারা বিরোধিতা করেছে। তারা কখনো নৌকার পক্ষে কাজ করেনি। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছি। এ কারণে আগে যেসব ইউনিয়ন ও পৌরসভায় বিএনপি বিজয়ী হয়েছিল, সেখানে এখন আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে।’ শুধু দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নয়, গত ৯ বছরে শাহরিয়ার আলম চারঘাট-বাঘার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকদের নিয়োগ করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু জানান, শাহরিয়ার আলমের নির্দেশে চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউনিয়নের মাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি করা হয়েছিল বিএনপি থেকে আসা রুহুল সরকারকে। আবার ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে মাড়িয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম কাকুলকে নিয়োগ না দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় জামায়াতের সাবেক ওয়ার্ড সভাপতি জমসেদ আলীকে। শলুয়া ইউনিয়নের নাওদাড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বিএনপি থেকে আসা গোলাম নবীকে। চারঘাট উপজেলার সারদা কলেজে বিএনপির মোহাব্বত আলীকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। চারঘাট উপজেলার শলুয়া ইউনিয়নের বালুদিয়ার বিএম কলেজে দুর্নীতির দায়ে সাময়িক বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ জামায়াত নেতা নুরুল ইসলাম মুকুলকে ফেরাতে ডিও লেটার দেন প্রতিমন্ত্রী। শলুয়া কলেজে প্রতিমন্ত্রীর ডিওতে সভাপতি করা হয় জামায়াত থেকে আসা বাবুল ইসলামকে। শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আমি হস্তক্ষেপ করি না। প্রতিষ্ঠানের লোকেরা এটি করে থাকেন। এ ছাড়া অনেকে আগে ভুল পথে ছিলেন, তারা এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেন। ফলে তাদের দলে নেওয়া হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর