শিরোনাম
সোমবার, ৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

সড়ক ও জনপথের আর্থিক অনিয়মের উৎস খুঁজে পেয়েছে দুদক

মোস্তফা কাজল

সরকারি সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আর্থিক অনিয়মের উৎস খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম। এসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে সড়ক নির্মাণ, কাজ শেষ হওয়ার আগে বিল প্রদান, টেন্ডার নিয়ে কারসাজি ও ঘুষ গ্রহণ। এদিকে গতকাল সড়ক ও জনপথের আর্থিক অনিয়ম প্রতিরোধে ২১ দফা সুপারিশমালা সংবলিত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো হয়। দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে এ প্রতিবেদন পাঠান। দুদকের এ প্রতিবেদনে সড়ক ও জনপথের বিধি, পরিচালন পদ্ধতি, সরকারি অর্থ ব্যয়ের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা হয়। জানা গেছে, দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা, অধিদফতরের বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা, সরেজমিন বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন, গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং কমিশনের গোয়েন্দা উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক নির্মাণে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর  অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইজিপি টেন্ডারিং শর্তানুসারে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন না করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের/ঠিকাদারের চাপে, অনেক সময় পরস্পর যোগসাজশে একশ্রেণির প্রকৌশলী/কর্মকর্তা সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে থাকেন। ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রচলিত প্রথায় পরিণত হয়েছে। কাজ পাওয়ার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি, পরামর্শক সংস্থা, সরকারি কর্মকর্তাদের উেকাচ প্রদান করতে হয় এমন অভিযোগও দুদকে রয়েছে। ফলে ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজের মান বজায় রেখে প্রকল্প শেষ করা ঠিকাদারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্মাণ কাজের এস্টিমেশন ও ডিজাইন দুর্নীতির একটি উৎস হয়ে থাকে।

প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সুপারিশমালা : দুদক প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সদস্যরা অনুসন্ধান শেষে দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপারিশ করেন (১) সড়ক নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে— পাথর ও ইট। উন্নতমানের খোয়া ছাড়া সড়ক নির্মাণ করা হলে স্থায়িত্ব বেশি টেকসই হয় না। উন্নতমানের খোয়া তৈরির জন্য প্রয়োজন পাথর, পিকেট বা ঝামা ইট অথবা এক নম্বর গ্রেডের ইট। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অধিকাংশ টেন্ডারে  স্পেসিফিকেশনে বর্ণিত যথাযথভাবে পেতে গেলে পাথর বা ঝামা ইট অথবা গ্রেড একের ইট ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা থাকে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চাপে অথবা প্রকৌশলীদের দায়িত্ব অবহেলা কিংবা পরস্পর যোগসাজশে অর্থ আত্মসাতের জন্য সড়ক নির্মাণে পাথর, ঝামা অথবা গ্রেড এক ইটের খোয়ার পরিবর্তে নিম্নমানের ইট দিয়ে খোয়া তৈরি করে সড়ক নির্মাণে ব্যবহার করেন। সড়ক নির্মাণে এমন দুর্নীতি বন্ধ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রতিটি সড়কের ক্ষেত্রে ডিজাইন অনুসারে সড়ক নির্মাণের সময় সড়ক বেডের রেশিও নিরূপণ করা বাধ্যতামূলককরণ প্রয়োজন। সড়ক নির্মাণ বাস্তবায়ন কাজে দেশীয় অর্থায়নে যেসব প্রকল্প করা হয় সেসব প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ে প্রতিদিন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অথবা সহকারী প্রকৌশলী বা উপসহকারী প্রকৌশলীরা এবং নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা যে মেজারমেন্ট বুকে স্বাক্ষর করেন তাতে পরিমাণগত কাজের পরিমাণ ও মান উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।

এ ছাড়াও স্পেসিফিকেশনে বর্ণিত গুণগতমান নিশ্চিতকরণের জন্য অন্যান্য টেস্ট সম্পাদন করে টেস্ট রিপোর্ট প্রত্যয়নপূর্বক সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পসমূহেও অনুরূপ তথ্য সংবলিত মেজারমেন্ট ও টেস্ট রিপোর্ট সংরক্ষণ করতে হবে। সড়ক নির্মাণে টেন্ডারের শর্তানুসারে উন্নত বালি ব্যবহার না করে নিম্নমানের বালি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সব কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল বিভাগের অধ্যাপক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নির্মাণকাজে বিশেষজ্ঞ, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের একাধিক মনিটরিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ ছাড়া সওজের নিজস্ব মনিটরিং ইউনিট গঠন করা যেতে পারে এবং সুনির্দিষ্ট কার্যপরিধির আলোকে মনিটরিং ইউনিট কাজের পরিমাণগত ও গুণগত মানের বিষয়ে রিপোর্ট প্রদান করবে। মনিটরিং ইউনিটের চূড়ান্ত রিপোর্ট ব্যতিরেকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত বিল প্রদান না করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। (২) প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন— বৃষ্টিপাত, বন্যা এবং নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণের ফলে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ থেকে উত্তরণের জন্য কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। (৩) সড়ক নির্মাণে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে বিটুমিন। সরকারিভাবে বিটুমিন আমদানির দায়িত্বে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি। এ ছাড়া, সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মহাসড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। যেসব নির্মাণ কাজে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করার কথা এ ক্ষেত্রেও ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন স্পেসিফিকেশন মোতাবেক এ ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্য সব বিটুমিনাস কাজে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিটুমিন ব্যবহার করে কাজের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করা যায় কিনা সে বিষয়ে গবেষণা করে বিদেশের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ কারিগরি প্রয়োজন ব্যতীত উন্নয়ন প্রকল্পের বিটুমিনাস কাজে ৬০-৭০ গ্রেড মানের বিটুমিন ব্যবহারের যে নির্দেশনা আছে তা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট মাঠ প্রকৌশলীরা ঠিকাদার কর্তৃক ব্যবহারের জন্য নির্মাণ সাইটে মজুদকৃত বিটুমিন পরীক্ষা করে এ মান নিশ্চিত করবেন। এই মান নিশ্চিতের পরীক্ষার ফলাফল সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রেড মানের তারতম্য হলে ঠিকাদার, প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদক আইনে মামলা দায়ের করা যেতে পারে। (৪) দেশের অধিকাংশ নির্মাণকারী সংস্থায় জেলা পর্যায়ের নির্বাহী প্রকৌশলীরা-পিপিআর অনুসারে সব দরপত্র আহ্বান ও নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করে থাকেন। সাধারণত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী অথবা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদমর্যাদার পদসমূহ সুপারভাইজিং ও মনিটরিংয়ের  দায়িত্বপ্রাপ্ত পদ। এ জাতীয় পদের কর্মকর্তাদের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের সরাসরি দায়িত্বে না রেখে সুপারভাইজিং ও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাজ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীদের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের দ্বারা ফাইনাল মেজারমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। (৫) সড়ক নির্মাণ কাজ শুরুর পূর্বেই রাস্তায় কিছু মাটির কাজ করতে হয় এবং কাজ চলাকালীন সড়কের পার্শ্বে মাটি ফেলতে হয়। এই মাটির কাজে অনিয়ম দুর্নীতির আরেকটি উৎস। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাটির কাজের প্রাক্কলন করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান মাটিকে কম দেখিয়ে পরবর্তীতে মাটি ভর্তি দেখিয়ে ভুয়া বিল করা হয়।

সর্বশেষ খবর