বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

মহাসড়কের বাঁকে বাঁকে মৃত্যুফাঁদ

১৫৪ ঝুঁকিপূর্ণ স্পট, পাঁচ বছরে নিহত ৩ হাজার

সাঈদুর রহমান রিমন

মহাসড়কের বাঁকে বাঁকে মৃত্যুফাঁদ

দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের দেড় শতাধিক বিপজ্জনক বাঁক এখন রীতিমতো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ অ্যাপ্রোচ রোডগুলো ডেকে আনছে ঘন ঘন দুর্ঘটনার বিপদ। গত তিন সপ্তাহে ১৪টি পয়েন্টে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক দুর্ঘটনায় অন্তত ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক ব্যক্তি। এ ১৪টি চরম ঝুঁকিপূর্ণ স্থানসহ সারা দেশে ১৫৪টি সড়কবাঁক ‘অ্যাক্সিডেন্ট পয়েন্ট’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। গত পাঁচ বছরেই সেসব স্থানে ১ হাজার ১৫০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় ৩ হাজার নিহত ও পাঁচ হাজার আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। পুলিশ সদর দফতর, হাসপাতাল, সড়ক নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্র (এআরসি) দেশের সড়কগুলোয় সমীক্ষা চালিয়ে ২০৯টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক থাকার কথা উল্লেখ করে। তবে এর মধ্যে ১৫৪টি বাঁক মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিপজ্জনক ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলোর মধ্যে কুমিল্লা জোনে ১২টি, সিলেট জোনে ১৪টি, চট্টগ্রাম জোনে ৩৩টি, খুলনায় ১১টি, বরিশাল জোনে ১৩টি, ঢাকা জোনে ২১টি, উত্তরবঙ্গের রংপুর জোনে ২৪টি ও রাজশাহীতে ২৬টি বাঁক রয়েছে বলে জানা গেছে।

এসব বাঁক প্রশস্তকরণসহ একাধিক লেনে পরিণত করার মাধ্যমে দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে নিতেই এতসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশুমার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর দুর্ঘটনাপ্রবণ বাঁকগুলো প্রশস্ত করার কাজ খুব দ্রুতই শুরু হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ কাজের জন্য ১৬৫ কোটি টাকা অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, অনেকেই মনে করেন রাস্তায় স্পিডব্রেকার থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে যায়, কিন্তু এ ধারণাটি ভুল। তাই স্পিডব্রেকার কমিয়ে সড়কের বিপজ্জনক বাঁকগুলো প্রশস্তকরণ ও চার লেনে উন্নীতকরণের পদক্ষেপ শিগগির বাস্তবায়ন হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের ১৭টি বিপজ্জনক বাঁক প্রশস্তকরণের কাজ সম্পন্নও করা হয়েছে। সেসব স্থানে গত চার মাসেও কোনো দুর্ঘটনার নজির নেই বলেও সড়ক ও জনপথের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন। কিন্তু বাকি সব বিপজ্জনক পয়েন্ট সহসা বিপদমুক্ত করা সম্ভব নয় বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিমত প্রকাশ করেন।

উত্তরবঙ্গে মোড়ে মোড়ে বিপদ : উত্তরবঙ্গের সড়ক-মহাসড়কে বিপজ্জনক মোড় আর অ্যাপ্রোচ রোডের যেন অভাব নেই। মাইলে মাইলে মোড়ের দেখা মেলে। কোনোটা এল টাইপের, কোনোটা বিপজ্জনক এস টাইপের মোড় বা বাঁক। অতিসম্প্রতি নাটোরে মর্মন্তুদ দুর্ঘটনাস্থলটি এস টাইপের বিপজ্জনক মোড়ে বলে জানিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা। বিপজ্জনক এসব বাঁকে প্রায়ই ঘটছে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা। অপরিকল্পিত এসব বাঁকের কারণে গত এক বছরেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ।

কুমিল্লার সড়ক বাঁক যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ : বিশ্বরোড নামে পরিচিত দেশের বৃহত্তম মহাসড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ৯৭ কিলোমিটার অংশ যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিপজ্জনক বাঁক, অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালনা, ওভারটেকিং, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি, মহাসড়কের ওপর যানবাহন থামিয়ে যাত্রী ও মালামাল ওঠানো-নামানোর কারণে প্রতিদিনই কুমিল্লা জোনে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার ফলে প্রতিনিয়ত মহাসড়কজুড়ে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষমাণ থাকতে হচ্ছে বাস, ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহন। জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি সময়ক্ষেপণ ও অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। গত তিন মাসে বিশ্বরোডের কুমিল্লা অংশে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। এ সময় আহত হয়েছেন অন্তত আড়াইশ যাত্রী।

নান্দনিক বাঁকে বাঁকে মৃত্যুর হাতছানি : বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সড়কের একেকটি মোড় যেন পর্যটকদের কাছে নান্দনিকতার হাতছানি। কিন্তু প্রতিটি বাঁকই ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর জানমালের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনে প্রায়ই। বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের অনেক সড়ক-মহাসড়কের বিপজ্জনক বাঁক-মোড়ে লেখা কোনো চিহ্ন পর্যন্ত দেওয়া নেই। বাঁকের শেষ মাথা পর্যন্ত না পৌঁছালে বোঝা যায় না বাঁক পেরিয়ে রাস্তাটি কোন দিকে মোড় নিয়েছে। বান্দরবানের সড়কের নান্দনিক বাঁকে বাঁকে মৃত্যু ওতপেতে থাকে। বান্দরবান থেকে থানচি পর্যন্ত যাওয়ার সড়কটি অধিকাংশ স্থানেই অতিমাত্রায় সরু। কিছু দূর পরপরই রয়েছে অতি বিপজ্জনক মোড়। সড়কের কোনো কোনো স্থানে দুটি গাড়ি একসঙ্গে ক্রস করতে পারে না। চট্টগ্রাম-হাটহাজারী-নাজিরহাট-রাউজান সড়কেরও বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৮টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে।

শাহজাদপুর-যশোর রোড যেন মৃত্যুফাঁদ! : শাহজাদপুর-পাবনা-কুষ্টিয়া-যশোর সড়ক-মহাসড়কের প্রায় ১০৮টি বাঁক যাত্রীদের জন্য মুহূর্তে মুহূর্তে বিপদ ডেকে আনছে। এ সড়ক-মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত শত শত পার্শ্ব সড়কগুলোতে নেই কোনো গতিরোধক! আছে পদে পদে শতেক বিড়ম্বনা। সড়ক মার্কিংগুলো না থাকায় অদক্ষ চালকেরা রাতের বেলায় দ্রুতগতিতে যানবাহন চালনাকালে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

সড়ক ও জনপথের একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার গাড়াদহ জোড়া ব্রিজ পার হওয়ার পর একটি, আলিফ সিএনজি স্টেশন সংলগ্ন কালিমন্দিরের সামনে একটি, বিসিক বাসস্ট্যান্ড ও পাড়কোলা বাজারের মাঝামাঝি এলাকায় একটি ‘দুর্ঘটনা বাঁক’ রয়েছে। নুকালী ব্রিজটি মহাসড়কের তুলনায় অনেক উঁচু ও সরু হওয়ায় এখানে প্রায়ই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এ ছাড়াও সরিষা সেতু এলাকায়, চাকলা বড় সেতুর আগে-পরে, পাবনা কাশিনাথপুরে দুটি, চরগোবিন্দ বাজারের অদূরের তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ দুটি বাঁকে হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে। এসব পয়েন্টে সর্বোচ্চ গতিবেগ ২০-৩০-৫০ কিলোমিটার লিখে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই সওজ কর্তৃপক্ষ তাদের দায়দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু বিপজ্জনক পয়েন্টে সড়ক মেরামত, সম্প্রসারণ বা ছোট আকারের ডিভাইডার যোগ করা হলে অনেক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে বলে বাস চালকরা মন্তব্য করেছেন।

সর্বশেষ খবর