বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

নওগাঁর সাত নদীই এখন মরা খাল

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

নওগাঁর সাত নদীই এখন মরা খাল

নওগাঁয় নদীতে বীজতলা

নওগাঁর সাত নদ-নদীর দশা এখন করুণ। এগুলো পানিশূন্য, মৃতপ্রায়। নদ-নদীগুলো হলো— আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, নাগর, শিব, ফকিরনি ও পুনর্ভবা। নাগর নদ নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন বিখ্যাত শিশুতোষ কবিতা। নদের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে কবিগুরুর ওই পঙিক্তর এখন আর মিল নেই। পুনর্ভবা নদীটি ঠাকুরগাঁওয়ে উৎপত্তি হওয়ার পর দিনাজপুর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। এরপর নওগাঁর পোরশা উপজেলার নিতপুর হয়ে আবার বাংলাদেশে এসেছে। মোট দৈর্ঘ্য ১৬০ কিলোমিটার। বাংলাদেশে পড়েছে ৮০ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুম ছাড়া এর কোথাও পানিপ্রবাহ থাকে না। আত্রাইয়ে পানি নেই বলে শিব ও ফকিরনিরও দুঃখের শেষ নেই। শুকিয়ে ধু-ধু এই শাখা নদ-নদী দুটি। তবে দখল-দূষণে ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গার যে প্রাণ যায় যায় অবস্থা, তা অগোচরেই রয়ে গেছে। শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত তুলসীগঙ্গার অস্তিত্বও বিলীন হওয়ার পথে। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার ধানপাড়া বিল এলাকা থেকে আত্রাই নদীর উৎপত্তি। দিনাজপুরের বিরামপুর, হাকিমপুর; জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর হয়ে নওগাঁ জেলায় এর প্রবেশ। দীর্ঘ ১১০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার মির্জাপুরে আত্রাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। একসময় খরস্রোতা ছিল এ নদী। নদীর দুই কূল ছাপিয়ে নওগাঁ ও বগুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করত। বড় বড় নৌকা ভিড়ত। এ নদীর পানিতে দুই পাশের ফসল উৎপাদন হতো। মাছও হতো প্রচুর। এক কথায় ব্যবসা ও কৃষি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখত এ নদী। কিন্তু আজ সেই নদীই মরা। কোনোরকম পানিই থাকে না। নদীর অনেকাংশ জুড়ে এখন ফসলের খেত। তাই পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী। ক্ষতিগ্রস্ত দুই পারের কৃষি ও কৃষকও। এই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য। ছোট যমুনায়ও বর্তমানে বর্ষা মৌসুম ছাড়া পানিপ্রবাহ থাকে না। বালু তোলা ও দখলের কারণে নদীটি দিন দিন অস্তিত্ব হারাচ্ছে। এ ছাড়া জয়পুরহাট চিনিকলের বর্জ্যে বছরের বেশির ভাগ সময় নদীর পানি নর্দমার মতো কালো থাকছে। নওগাঁর নদ-নদীগুলোর এ দুরবস্থার জন্য আরেকটি বিষয়কে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। তা হলো গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদ-নদীতে পানি না পেয়ে কৃষক সেচের জন্য ক্রমেই গভীর নলকূপনির্ভর হচ্ছেন। এর ফলে ভূ-পৃষ্ঠের পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। নওগাঁ শহরের পার-নওগাঁর বিশিষ্ট চাল ব্যবসায়ী শেখ ফরিদ বলেন, নওগাঁর ছোট-বড় সাতটি নদ-নদীই এখন মৃতপ্রায়। একসময় বড় বড় পালতোলা নৌকা দিয়ে পণ্য আনা-নেওয়া হতো এসব নদ-নদী দিয়ে। কিন্তু এখন এতে ছয় মাসও পানি থাকে না। শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদীতে চলছে দখল ও দূষণের প্রতিযোগিতা। ছোট যমুনার দুই তীরেই অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। তীরে গড়ে তোলা চাতাল থেকে বিষাক্ত বর্জ্য ও ছাই ফেলা হচ্ছে নদ-নদীতে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদ-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে না, মানুষই এগুলোকে শুকিয়ে ফেলছে। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, দীর্ঘদিন ধরে বোরো চাষাবাদ করতে পাম্প দিয়ে নদ-নদীর পানি তুলে ফেলা। নদ-নদী বাঁচাতে খনন করে এর প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে প্রতিটি নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমঝোতায় আসতে হবে। নদীকে নদীর কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, নওগাঁ সদর উপজেলার তাজনগরে ষাটের দশকে তুলসীগঙ্গা নদীর গতি বন্ধ করে ছোট যমুনা নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেওয়ার কারণেই নদীটির নওগাঁ জেলার অংশে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা মরে গেছে। শুধু তাই নয়, নওগাঁর সব কটি নদ-নদীর একই অবস্থা। তবে জনতার দাবির সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা চাইলে নদ-নদীর নাব্য সৃষ্টির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সর্বশেষ খবর