বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-১৩

নবাবী আমলের সেই আহসান মঞ্জিল

মাহবুব মমতাজী

নবাবী আমলের সেই আহসান মঞ্জিল

ঢাকার নবাবদের নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম আহসান মঞ্জিল। বুড়িগঙ্গার কোলঘেঁষা এ অনন্য স্থাপত্যটি পুরান ঢাকার ইসলামপুরে অবস্থিত। এটি প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার নবাব আবদুল গণি। নবাব তার প্রাণপ্রিয় পুত্র খাজা আহসান উল্লাহর নামে এর নাম রাখেন আহসান মঞ্জিল। এখন এটি জাদুঘর। ঐতিহ্যবাহী নবাববাড়ি হিসেবে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী এটি পরিদর্শন করতে আসেন। বিদেশি পর্যটকদের কাছেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই প্রাসাদ। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা আহসান মঞ্জিলকে গত বছর নতুনভাবে রাঙিয়ে আরও দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আঙিনায় বিরল প্রজাতির বৃক্ষ এবং ফুটন্ত ফুল যে কাউকে রোমাঞ্চিত করবে। আহসান মঞ্জিলের অভ্যন্তরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দেখলে কয়েকশ বছর আগের একটি শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। উত্সুক আগন্তুকরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন নবাবী শাসনামলের খণ্ডচিত্র। জানা যায়, নবাবদের সব ধরনের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত এখান থেকেই নেওয়া হতো। বিশেষ করে সমাজ কাঠামো, জমিদারি এবং রাজনীতিসহ সব কিছুরই কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ প্রাসাদটি। রাতে অন্দরমহলেই বসত নাচের আসর। তখন নর্তকীদের নূপুরের শব্দে উছলে উঠত বুড়িগঙ্গার ঢেউ। তবে কালের পরিক্রমায় নবাবদের সেই আড়ম্বরপূর্ণ বিলাসী দিনগুলো আজ আর নেই। এখন এসব শুধুই ইতিহাস। অবশ্য নবাবদের জমিদারি কর্মকাণ্ড এখান থেকে পরিচালিত না হলেও তাদের নিদর্শনগুলো রয়েছে কালের সাক্ষী হয়ে। ১৮৫৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৮৭২ সালে। সেই হিসেবে এর বয়স প্রায় দেড়শ বছর। তাই প্রাচীন এ স্থাপত্যটি বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ। এটি দেখভালের দায়িত্বে আছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। পুরো জাদুঘরের ২৩টি কক্ষে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নবাবী আমলের বিভিন্ন নিদর্শন। আর ৯টি কক্ষে নতুন করে যোগ হওয়া ১২টি গ্যালারিতে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত এবং ১৯০৪ সালে ফ্রিত্জ কাপের তোলা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। নতুন গ্যালারিগুলোর কাজ শেষ হয় গত বছর। একই সঙ্গে আহসান মঞ্জিলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আশপাশে ৪০টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। ক্রমানুসারে গ্যালারিগুলোতে শোভা পাচ্ছে নবাবদের ব্যবহূত বিভিন্ন জিনিসপত্র। ডাইনিং কক্ষ, সিন্ধুক, বড় আয়না, আলমারি, জমিদারদের বিশ্বস্ত হাতি, পিতল ও কাঁসার থালাবাসন, ফিরোজ জংয়ের গজদন্তসহ মাথার কঙ্কাল, অলংকার, চেয়ার-টেবিল, আতরদানি, পানদান, হাতির দাতে তৈরি চিরুনি, কাঁচি, সোফাসমেত ড্রয়িং রুম এবং বাইজি নাচের ঘরসহ ৪ হাজারের বেশি নিদর্শনে সমৃদ্ধ এ জাদুঘর। আরও রয়েছে ঢাকায় বিদ্যুৎ ও পানিসহ দেশে দেশে জনকল্যাণমূলক কাজে নবাবদের অবদানের বিবরণ, আইনসংক্রান্ত বই, পানির ড্রাম, বিভিন্ন সময়ে নবাবদের নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ-সংক্রান্ত তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোর কাটিং, চিঠি, তরবারি, ফেজটুপি, হীরক, হুক্কাসহ আরও অনেক নিদর্শন। এক্ষেত্রে ১৩ নম্বর গ্যালারিটি দর্শনার্থীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে সে সময়ের সামাজিক, রাজনীতিবিদ ও বিখ্যাত মনীষীদের ফ্রেমবদ্ধ ছবি স্থান পেয়েছে। এতে লিপিবদ্ধ রয়েছে তাদের পরিচিতিসহ নানা অবদানের কথা। বিশেষ করে ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং তৎকালীন নিখিল ভারত নেতৃবৃন্দের একই ফ্রেমের বৃহৎ ছবি বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। এ ছাড়াও এ প্রাসাদের ছাদের ওপর একটি গম্বুজ রয়েছে, যা এক সময় ঢাকার সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে বিবেচিত হতো। এর পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তে দুটি মনোরম খিলান রয়েছে। আর পূর্ব পাশে রয়েছে বৈঠকখানা ও একটি পাঠাগার। এসব নিদর্শনের দর্শনার্থীদের কাছে যথেষ্ট আবেদন রয়েছে। তবে প্রাচীন এ জাদুঘর সবকিছুতে সমৃদ্ধ থাকলেও ইটের বদলে টিনের সীমানা প্রাচীর, প্রধান ফটক ছাড়া বাকি তিন দিকের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে যানবাহন পার্কিং করে রাখা ও অবাঞ্ছিত ব্যানার-ফেস্টুনের কারণে ম্লান হতে বসেছে জাদুঘরটির শত বছরের ঐতিহ্য। এ ছাড়া সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে ফুটপাথে বসেছে দোকানপাট। এতে সরু হয়ে গেছে সামনের সড়ক। ফলে আহসান মঞ্জিলে আসা দর্শনার্থীদের চোখে-মুখে দেখা যায় এক ধরনের অসন্তুষ্টির ছাপ। এখানে রিকশা-গাড়ির জট সহজে ছাড়তে চায় না। নবাববাড়ির সামনের যানজটের অবস্থা বেশি খারাপ। আহসান মঞ্জিল জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আহসান মঞ্জিল জাদুঘর খোলা থাকে। এতে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য প্রবেশ মূল্য ২০, সার্কভুক্ত দেশ ২০ এবং অন্য বিদেশিদের জন্য টিকিট মূল্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করা। প্রতিদিন গড়ে এখানে ৫০০ দর্শনার্থী আসেন। এ ছাড়া ছুটি ও বিশেষ দিনগুলোতে চার থেকে পাঁচ হাজার দর্শনার্থী হয়ে থাকে।

সর্বশেষ খবর