বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাবনার সব নদী হারিয়ে গেছে

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। অথচ অবহেলায় হারাচ্ছে সব নদী। নদী বাঁচাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১৪তম পর্ব আজ।

এস এ আসাদ, পাবনা

পাবনার সব নদী হারিয়ে গেছে

চাটমোহর বড়াল নদীর চিত্র

বছরের পর বছর পলি জমে পাবনার নদ-নদীগুলো হারিয়ে ফেলেছে স্বকীয়তা। নাব্য সংকটে এগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব, জলবায়ুর পরিবর্তন ও নদ-নদীর উৎসমুখে স্লুইস গেট নির্মাণ এবং ক্রসবাঁধের প্রভাবে নদ-নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা ও আয়তন কমে এসেছে। অধিকাংশ নদ-নদী মাছের খামার আর ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। ফলে জেলার ৬২৮ কিলোমিটার নদীপথের মধ্যে ৪৫০ কিলোমিটার বিলুপ্ত হয়ে কোনোভাবে টিকে আছে মাত্র ১৭৮ কিলোমিটার নৌপথ। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে ১৬টি নদীবন্দর ও ১২টি নৌরুট। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, অর্থনীতি। সর্বোপরি হারাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। বিভিন্ন সময় জেলার লোকজন নদ-নদী দখলমুক্ত করে পুনঃখননের দাবি জানালেও প্রশাসনের মাথাব্যথা নেই।

জানা গেছে, পাবনার দক্ষিণ-পশ্চিমে পদ্মা, পুবে যমুনা নদী ও উত্তরে রয়েছে বড়াল নদ এবং জেলা শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। এ ছাড়া পাবনার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গারুলিয়া, চিকনাই, আত্রাই, চন্দ্রাবতী, গুমানী, কাগেশ্বরী, ট্যাপাগাড়ি, শুটকিদহসহ অসংখ্য শাখা নদ-নদী। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও এসব নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকলেও বর্তমান চিত্র ভিন্ন। আর এসব নদ-নদীর ওপর নির্ভর করেই সমৃদ্ধ হয়েছিল জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি ও অর্থনীতি। কিন্তু দখল, দূষণ ও আবর্জনায় নদ-নদীগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার ১৬টি নদীবন্দর বা ঘাট। এর মধ্যে অন্যতম বাজিদপুর, ঈশ্বরদীর সাড়াঘাট, পাকশী, বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী, কাজিরহাট, ভারেঙ্গা, নাকালিয়া, ভাঙ্গুরার বড়াল ব্রিজঘাট, চাটমোহরের নূরনগর, অষ্টমনীষা, বোথর ঘাট, মির্জাপুরসহ বিভিন্ন নৌবন্দর ও ঘাট। এদিকে ১৯৮১ সালে জেলার অন্যতম নদ বড়ালের উৎসমুখ রাজশহীর চারঘাটে স্লুইস গেট নির্মাণ, পরে চাটমোহর উপজেলার নূরনগর, রামনগর ও বোথর এলাকায় নদে আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণেও নৌপথের গতিপথ নষ্টের অন্যতম কারণ। তবে পরবর্তী সময়ে বোথরের বাঁধ অপসারণ করে ব্রিজ নির্মিত হলে আগের অবস্থা আর ফিরে পায়নি বড়াল। পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল হক জানান, পাবনা জেলার তথ্যমতে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকায় সহজেই নৌযান চলাচল করত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের নদীপথের প্রায় ১২টি নৌরুট বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু পদ্মা ও যমুনার নদীপথে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও শুকনো মৌসুমে চর ও ডুবোচরের কারণে নৌযান চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়।

পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহসভাপতি আলী মুর্তজা বিশ্বাস সনি বলেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাবনা শহরে ইছামতী নদীকে কেন্দ্র করে তাঁত, হোসিয়ারি শিল্প, কাঁচিশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পের বিস্তার ঘটে। শুধু পাবনা শহরই নয়, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা বড়াল নদকে কেন্দ্র করে ওই তিন উপজেলায় দুগ্ধশিল্পসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। একই সঙ্গে পদ্মা ও যমুনার জন্য অন্যান্য উপজেলার সঙ্গে নৌপথের মাধ্যমে সারা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ স্থপিত হয় পাবনার। অথচ নদীপথ বিলীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্পসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এ জেলা। অবিলম্বে আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি চালুর দাবি জানান তিনি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ির উপপরিচালক বিভূতিভূষণ সরকার বলেন, নদী ও বিলের পানি দিয়ে আগে চাষাবাদ হলেও বর্তমানে নদীগুলো পানিশূন্য হওয়ায় বিকল্প পন্থায় সেচব্যবস্থা করতে হয় কৃষকদের। এতে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়ে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহা. নাজমুল ইসলাম বলেন, নদ-নদী হারিয়ে যাওয়ার ফলে এ অঞ্চলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে চলনবিলাঞ্চলে শুকনো মৌসুমে কৃত্রিমভাবে সেচকাজ করতে হচ্ছে কৃষকদের। এক কথায় বলতে গলে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে; যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ। বড়াল নদ রক্ষা আন্দোলনের সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, দেশের রাষ্ট্রীয় পলিসিতে নদী রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেই। বলা যায়, যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারা নদী-খাল-বিল দখলে মরিয়া হচ্ছে। কেউ কিছু বলতে পারছেন না তাদের। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে আর নদী খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে উজানের দেশগুলোরও আন্তরিকতা প্রয়োজন। পাবনার জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘নদ-নদীগুলো দখলমুক্ত করে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পাবনা শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত একসময়ের প্রমত্তা ইছামতী বর্তমানে মরা খালে পরিণত হয়েছে। আমার জানা মতে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০০৭ সালে ইছামতী নদীর দুই পাশে প্রায় ৩০০ জন অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। খুব দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু করা হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে অবশ্যই এ উদ্ধার কার্যক্রম সহজ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

সর্বশেষ খবর