বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইজারাদারের খপ্পরে ভাওয়াল রাজার বাড়ি

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-২১

মাহবুব মমতাজী

ইজারাদারের খপ্পরে ভাওয়াল রাজার বাড়ি

ইজারাদারের খপ্পরে পড়ে নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে পুরান ঢাকার ভাওয়াল রাজবাড়ি। ভাওয়াল রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর এই বাড়ির চারপাশ প্রায় দখল সম্পন্ন। টিকে আছে মাত্র কর্মচারীদের ঘরগুলো। রাজার সম্পদের লোভে তার মেজরানী তাকে বিষ খাইয়েছিলেন বলে কথিত আছে। কিন্তু কপালগুণে বেঁচে যান রাজা। পরে অভিমান করে ছেড়ে যান রাজত্ব। বেছে নেন সন্ন্যাসজীবন। প্রায় ১২ বছর পর তাকে সন্ন্যাসরূপে পাওয়া গিয়েছিল  চকবাজারের নলগোলার এই বাড়িতে। ভাওয়াল রাজার মৃত্যু ও তার সন্ধান নিয়ে রয়েছে এক রহস্য। ঐতিহ্যে ঘেরা এই বাড়ির অধিকাংশই নেই বললেই চলে। একসময় বাড়িটি শিল্পীর কল্পনার ছবির মতো ছিল। এর সঙ্গে এখন বাস্তবের আর মিল পাওয়া যায় না। এখন ১৭৮ জন ইজারাদারের দখলে ভাওয়াল রাজবাড়ি। আছে আরও অবৈধ দখলদার। বাড়ির মূল ভবনের কিছুই অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। যে যেভাবে পেরেছেন এই স্টেটে ঘর বানিয়েছেন। এখনো ভাঙা-গড়ার কাজ চলে। সরেজমিন দেখা যায়, ঘিঞ্জি এক এলাকা। পাশেই নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও নলগোলা স্কুল। সরু গলি দিয়ে পুবে যেতে দুই পাশে টিনের টংঘর। প্লাস্টিক, ভাঙাড়ি আর পুরনো স্যান্ডেলের গোডাউন। গলি ধরে শেষ মাথা পর্যন্ত এগোতেই মেলে রাজার বাড়ির গেট। গেটেই বসে দুজন শ্রমিক কাচের তৈরি বাটি প্যাকেটজাত করছেন। দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ইট-বালু-সিমেন্টের কাজ। বাঁ পাশে ওপরে ওঠার লোহার সিঁড়ি। বাড়ির ছাদে গিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই মনে হলো এ যেন এক বস্তি। রাজবাড়ির চিহ্ন খোঁজাও যেন আকাশকুসুম কল্পনার শামিল। ছাদে টিনের একটি বড় ঘর। যেখানে নরসিংদী থেকে তৈরি কাচের গ্লাস, বাটি ও প্লেটের রং এবং প্যাকেজিং হয়। সেখানে কর্মরত সৈকত নামে এক শ্রমিক জানালেন, তারা বাবুল নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে বাড়িটি ভাড়া নিয়েছেন। জানা যায়, চকবাজারের নলগোলা এলাকার ৪৭ ঈশ্বরচন্দ্র শীল রোডে অবস্থিত শতাধিক বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বাড়িটিই ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ি কিংবা ভাওয়াল স্টেট হিসেবে পরিচিত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী হাসান পিল্লু এই প্রতিবেদককে জানান, ‘ভাওয়াল স্টেটের এই জায়গা যারা দীর্ঘদিনের ইজারা নিয়েছেন, তারাই এর পরিবর্তন করে এক তলা-দুই তলা বাড়ি বানিয়েছেন। এটি সংরক্ষণের জন্য আমরা প্রশাসনিকভাবে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করব তার পথও পাই না।’ লোকমুখে ভাওয়াল রাজার এক রহস্যাবৃত কাহিনী রয়েছে।

তা হলো ১৯০৯ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি। ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীর মেজ ছেলে রমেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী। চিকিৎসার প্রয়োজন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য ২৪ বছরের মেজ কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী পারিবারিক সিদ্ধান্তে ভারতের দার্জিলিং যান। সঙ্গী হন ২০ বছরের স্ত্রী (মেজরানী) বিভাবতী দেবী, বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাশগুপ্তসহ ব্যক্তিগত কর্মচারী মিলে ২৭ জন। দলবল নিয়ে ২৫ এপ্রিল মেজ কুমার দার্জিলিং পৌঁছেন। দার্জিলিং যাওয়ার মাত্র ১৫ দিন আগে মেজ কুমার সালনা কাচারির কাছে জোলারপাড় জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করে একটি ছবি তুলেছিলেন। এ ছবিটিই টাইগার ফটো নামে পরিচিত। এ ছবিটি উনবিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম ছবি হিসেবে বাংলাদেশ আর্কাইভসে স্থান পায়। মে মাসের শুরুতে মেজ কুমারের পেটে ব্যথাসহ নানা রোগ দেখা দেয়। প্রতিদিন দার্জিলিং থেকে জয়দেবপুরে তারবার্তার মাধ্যমে রাজার (মেজ কুমার) স্বাস্থ্যের খবর পাঠানো হতো। প্রথম টেলিগ্রামে রাজার ৯৯ ডিগ্রি জ্বর, পরের টেলিগ্রামে জ্বর বৃদ্ধি, পেটে যন্ত্রণা, দার্জিলিং সিভিল সার্জন দেখে গেছেন ইত্যাদি খবর আসতে থাকে। ৭ মে সন্ধ্যা থেকে কুমারের অবস্থার আরও অবনতি বলে স্ত্রীর পক্ষ থেকে জানানো হয়। ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও বমি, রক্তমিশ্রিত পায়খানা হতে থাকে। ৮ মে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে কোনো একসময় রাজার মৃত্যু হয় বলে রটে যায়। দার্জিলিংয়ের শ্মশানে তড়িঘড়ি শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। ১০ মে মেজ রানী ও অন্যরা জয়দেবপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ১৮ মে মেজ কুমারের শ্রাদ্ধ করা হয়। গতানুগতিকভাবে এ কাহিনী এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাওয়ালের এই রাজার জীবন-মৃত্যুর কাহিনীর এখানেই শেষ হয়নি। শ্রাদ্ধের দিনই গুঞ্জন ওঠে মেজ কুমারের দেহের নাকি সৎকার হয়নি। ওইদিন শ্মশানঘাটে মেজ কুমারের লাশ নেওয়ার পর শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। এর মধ্যে লাশ ফেলে লোকজন শ্মশানঘাট থেকে অন্যত্র আশ্রয় নেন। বৃষ্টির পর শ্মশানে গিয়ে তারা আর লাশটি দেখতে পাননি। এর ১২ বছর পর ১৯২১ সালের ৪ মে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে নলগোলায় আত্মপ্রকাশ ঘটে গেরুয়া পরা এক সন্ন্যাসীর। নানা তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, তিনিই সেই ভাওয়াল রাজা। অভিযোগ ওঠে, তাকে মেজ রানী বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।

সর্বশেষ খবর