বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

অবহেলা ভয়ঙ্কর

মির্জা মেহেদী তমাল

অবহেলা ভয়ঙ্কর

১৩ বছরের শিশু বিউটি বেগম (ছদ্মনাম)। মিষ্টি হাসির ছোট্ট মেয়েটির লাশ পাওয়া গেল ঘরের মধ্যে। আড়ার সঙ্গে গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঝুলে ছিল। সবার অজান্তে কখন যে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েছে, কেউ তা বলতে পারেনি। সকালে ঝুলন্ত অবস্থায় তার বাবা আবুল হাওলাদারের চোখে পড়ে। বিউটি বলেই চিৎকার করে ওঠেন হাওলাদার। দৌড়ে গিয়ে প্রাণপ্রিয় মেয়েটির পা জোড়া উঁচিয়ে ধরেন। যদি গলায় ফাঁসটা কম লাগে, তাতে করে তো মেয়েটি প্রাণে বাঁচবে। কিন্তু বাবার এই ভাবনাটা একদমই ভুল ছিল। ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া ঝুলে থাকা নিথর শরীরটা ধরেই বাবা বুঝতে পারেন, মেয়েটি চলে গেছে আরও অনেক আগেই। তার চিৎকার চেঁচামেচিতে বাড়ির লোকজন ছুটে আসে। শুনে সেখানে আসে পুলিশও। তার আগেই বাবা-মা প্রিয় সন্তানের লাশ দড়ি ছিঁড়ে নামিয়ে আনেন। তাদের গগনবিদারী চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। ঘটনাটি কয়েক সপ্তাহ আগের। বরগুনা সদর উপজেলার গুলবুনিয়া গ্রামের।

বিউটির মৃত্যুর সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। দলে দলে  লোক ছুটে আসে লাশ দেখতে। সবাই প্রশ্ন তোলে, এতটুকু বাচ্চা কেন এ কাজ করল? বাবা-মায়েরও একই প্রশ্ন। তারাও জানে না, কেন তাদের সন্তানটি এভাবে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করল! তারা নিজেরাও হতবাক। এমন প্রশ্ন যখন চারদিকজুড়ে, পুলিশ তখন বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে থাকে। পুলিশ কর্মকর্তাদেরও মাথায় ঢুকছে না, একটি শিশু কেন আত্মহত্যা করবে। কী এমন হয়েছে, যে কারণে তাকে আত্মহত্যা করতে হবে! বাবা-মা নেপথ্যের কোনো কিছু বলতে পারছে না বলেই পুলিশের কাছে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পুলিশ মাঠে নামে তদন্তে। পুলিশ নিশ্চিত, অবশ্যই এর পেছনে কোনো ঘটনা রয়েছে। যা হয় তো কেউ জানে না। এমন কিছু আছে, যেখানে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি ১৩ বছর বয়সী মেয়েটি। নানা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে পুলিশ তদন্তে নেমে পড়ে। বরগুনা সদর থানা পুলিশ নিজের মতো করে বিউটির আত্মহত্যার পেছনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। বিউটির মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে কয়েক দিন। পুলিশ যায় বিউটিদের বাসায়। বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বাবা আবুল হাওলাদার তেমন কিছুই বলতে পারেন না। শুধু বলেন, ‘মেয়েটি খুব হাসিখুশি ছিল। কিন্তু কয়েক দিন ধরে তার মন খারাপ দেখতাম। চুপচাপ ঘরে বসে থাকত। কথা বললে জবাব দিত না। কিছু একটা ভাবত। খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছি ঠিক হয়ে যাবে।’ বিউটির মা পুলিশকে জানান, ‘তার মেয়ে স্কুলে যেতে চাইত না। এ জন্য ওকে বকা দিয়েছি। একদিন মেরেছি। তবে ও কিছু একটা বলতে চাইত আমার কাছে। কিন্তু আমি ভাবতাম, স্কুলে যাবে না বলে, কিছু বলতে চায়। তাই আমি শুনতাম না। তবে ওরে যেন কারা রাস্তাঘাটে খারাপ কথা বলত। এমন কিছু বলছিল একদিন। ওটা নিয়েও আমি গুরুত্ব দিইনি।’

পুলিশ এসব কথা শুনে নিশ্চিত হয়, কিছু একটা আছে। পুলিশ এবার যায় তার স্কুল ও তার আশপাশ এলাকায়। যেখানে বিউটি খেলাধুলা করত, যাদের সঙ্গে পড়ত-তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে। একসময় পুলিশ একটি ক্লু খুঁজে পায়। বিউটির এক আত্মীয়র কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় পুলিশ। সেই আত্মীয় জানান, বিউটি যৌন হয়রানির শিকার হওয়া একটি শিশু। পুলিশ এমন কথা শুনে একটা বড় ধরনের ধাক্কা খায়। খোঁজ নিতে থাকে। গুলবুনিয়া গ্রামের আরও বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে পুলিশ একই তথ্য পায়। একই গ্রামের ইব্রাহীম সিকদারের বখাটে ছেলে বরগুনা সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ইমাম হোসেন ইছা (১৯) প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত বিউটিকে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে, কখনো বাড়ির পাশের গুলবুনিয়ার বাজারে হাসিকে  প্রেমের প্রস্তাব দেয় ইছা। অনন্যোপায় হয়ে একসময় প্রলোভনের শিকার হয় বিউটি। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে বিউটিকে নির্যাতনের নানা তথ্য। একদিন বাড়ির পাশের একটি নির্জন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় বিউটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ছবি তোলে ইছা। পরে সেই ছবি ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলে প্রায়ই বিউটিকে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন করতে থাকে ইছা। এরপর একদিন ইছার মোবাইল থেকে সেই ছবি চুরি করে নেয় ইছার ঘনিষ্ঠ সহযোগী একই গ্রামের লিটনের  ছেলে নয়ন (১৬)। এরপর দরিদ্র শিশু বিউটিকে মেনে নিতে হয় বখাটে নয়নের অনৈতিক আবদারও। ছবি ফাঁস করে  দেওয়ার কথা বলে নয়নও প্রায়ই তাকে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন করত। নয়নের মোবাইল ফোনের ছবি যায় একই গ্রামের মাহতাব আকনের ছেলে সুমনের কাছে (১৭)। সেও ফাঁদে ফেলে বিউটিকে যৌন নির্যাতন করত। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে নয়নকে। নয়ন জানায়, ইছার  মোবাইল থেকে সে বিউটির ছবি চুরি করেছিল। ইছা বিউটিকে মোবাইলের ছবি ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলে  যৌন হয়রানি চালিয়ে আসছিল। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ইছা। সে জানায়, নয়ন ও সুমনই বিউটিকে নির্যাতন করেছে। তবে পুলিশ নিশ্চিত, এরা বিউটির নির্যাতনকারী।  পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, তদন্ত করে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, যৌন হয়রানি থেকে নিস্তার পেতেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল শিশু বিউটি। আর এসব কারণে আত্মহত্যার আগে মনমরা হয়ে থাকত বিউটি। বিষয়টি বাবা-মায়ের চোখে পড়লেও তারা পাত্তা দেননি। বিউটি এ বিষয়ে তার বাবা-মাকেও বলার চেষ্টা করেছে। একবার তার মায়ের সঙ্গে আলাপও করেছে। কিন্তু তার মা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। বিউটি কেন স্কুল যেতে চাইত না, তা পরিষ্কার করে জানতে চাননি তার মা। উল্টো তাকে বকা দিয়েছেন, মেরেছেনও। এতে করে শেষ ভরসাটুকু শিশু বিউটি হারিয়ে ফেলে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সন্তানদের যে কোনো কথা অবশ্যই বাবা-মাকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিউটির বাবা-মা যদি তার কথাবার্তাকে গুরুত্ব দিতেন, হয়তো এমন করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর