শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

চারপাশে বিদেশি প্রতারক

মির্জা মেহেদী তমাল

চারপাশে বিদেশি প্রতারক

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিকিৎসক আসিফ রহমান (ছদ্মনাম)। সচ্ছল এই চিকিৎসকের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় এক ব্রিটিশ নাগরিকের। পরে তাদের কথা হয় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। কেউ কাউকে না দেখলেও কথা বলেই অল্প দিনে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। এক সময় চিকিৎসক বুঝতে পারেন, ব্রিটিশ ওই নাগরিক প্রকৃতপক্ষে একজন আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের সদস্য। কিন্তু ততদিনে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। টাকা-পয়সা খুইয়ে চিকিৎসক তখন সর্বস্বান্ত।

রাজধানীর কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা মাসুদ। কেনাবেচার একটি ওয়েবসাইট থেকে জাপানে সহজ ভিসার একটি বিজ্ঞাপন থেকে ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। মাসুদ ফোন করার পর এক ভদ্রলোক ফোন ধরেন। তিনি নিজেকে জাপানি অ্যাম্বাসির ফার্স্ট সেক্রেটারি তাকেসি ইয়োগি বলে পরিচয় দেন। ইংরেজিতে পারদর্শী ওই ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়ের পর তাদের স্কাইপিতে কথা হয়।

এক পর্যায়ে জাপানি ভদ্রলোকটি মাসুদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অ্যাম্বাসির সামনে যেতে বলেন। জাপানি কর্মকর্তার ব্যাপারে মাসুদের বড় ভাই ওয়াসিম খেঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ওই নামে ঢাকার অ্যাম্বাসির কোনো কর্মকর্তা নেই। একই নামের অ্যাম্বাসেডর আছেন দিল্লির জাপান অ্যাম্বাসিতে। বুঝতে পারেন তারা প্রতারিত হতে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত অবৈধ বিদেশিরা এমনই সব ভয়ঙ্কর প্রতারণার জাল ছড়িয়ে দিয়েছেন রাজধানীসহ সারা দেশে। তাদের অত্যাধুনিক সব প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শুধু টাকা আত্মসাতই নয়, ভিনদেশি এই নাগরিকরা বাংলাদেশে অবস্থান করে খুন, ডাকাতি থেকে শুরু করে অস্ত্র, মাদক ও জাল টাকার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। আলিশান ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে করছেন অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা। হালে এই বিদেশিদের নজর এখন অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ইতিমধ্যে এটিএম কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ফাঁস হয়েছে। দিনে দিনে এই ভিনদেশি নাগরিকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা বলেছেন, বিদেশিদের বাংলাদেশে অবস্থানের বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখার দায়িত্ব পুলিশের বিশেষ শাখার। কতদিন ধরে কে কোথায় অবস্থান করছে সেসব তথ্য তারা সংগ্রহ করছে। অবৈধ অবস্থানকারীরা কোথায় কি করছেন সে বিষয়ে সুপারভিশন বাড়ানো প্রয়োজন। তবে মানুষকে সচেতন থাকতে হবে তারা যেন এদের প্রতারণায় না পড়ে। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি অবৈধ নাগরিকদের অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীও উদ্বিগ্ন। তাদের প্রতারণার কৌশল দেখে হতবাক দেশের গোয়েন্দারা। পুলিশ সদর দফতর থেকে ৬৪ জেলা পুলিশ সুপার ও সব কয়টি মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনারকে অবৈধ বিদেশিদের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অ্যালার্ট থাকতে বলা হয়েছে দেশের সবকটি ইমিগ্রেশন ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক বছরে ভিনদেশি সহস্রাধিক নাগরিকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পড়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হলেও নানা কারণে তাদের আটকে রাখা যাচ্ছে না। জেল থেকে বেরিয়েই তারা ফের অপরাধে জড়াচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চাকরি ও ব্যবসার কাগজপত্র নিয়ে বৈধভাবে বাংলাদেশে আসার পর অনেক বিদেশি বেছে নিয়েছে অনৈতিক সব ধরনের কাজ। আবার অনেকে অবৈধপথে বাংলাদেশে এসেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। পুলিশের কাছে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। হাতেনাতে ধরা পড়লেই কেবল তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সূত্র জানায়, বিশ্বের ১২টি দেশের অন্তত দুই হাজারের বেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এর মধ্যে নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের নাগরিকের সংখ্যাই বেশি। তারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের নেই ভিসার মেয়াদ। আবার অনেকে সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে আসছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। কিন্তু ওই সব বিদেশি কোথায় যায়, কী করে, কোন এলাকায় বসবাস করে তার কোনো খোঁজ রাখছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এদের বড় একটি অংশই বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে উন্নত দেশের ভিসা দেওয়ার পাশাপাশি নাগরিকত্ব করিয়ে দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দেশের কিছু অসাধু ব্যক্তি এসব বিদেশি নাগরিককে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এসব প্রতারকের খপ্পরে পড়ে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগ প্রতিদিনই জমা হচ্ছে পুলিশের কাছে। গত এক বছরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদেশি নাগরিকদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার অন্তত সহস াধিক বাংলাদেশি। আর এ সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে শতাধিক বিদেশিকে। তারা অল্প সময় কারাগারে থেকে জামিনে বেরিয়ে এসেছে। দেশে বসে এসব বিদেশি অপরাধী কোথায় যায়, কী করে, কোন এলাকায় বসবাস করে সেসব প্রয়োজনীয় তথ্য রাখতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। সূত্র জানায়, অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশিদের বড় একটি অংশ অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে বিভিন্ন দেশের ভিসা ও নাগরিকত্ব করিয়ে দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর