শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

সম্ভাবনার নতুন গন্তব্য মাতারবাড়ী

গভীর এ সমুদ্রবন্দর বদলে দেবে অর্থনীতি হ তিন টার্মিনালেও চাহিদা মিটবে না

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম

সম্ভাবনার নতুন গন্তব্য মাতারবাড়ী

চট্টগ্রাম বন্দরে বাস্তবায়নাধীন আরও তিনটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ হলেও ‘ভিশন-২০৪১’ অর্জনে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না। এ কারণে দরকার একটি গভীর সমুদ্রবন্দর। সময়ের এই চাহিদা পূরণে ২০২৩ সালের মধ্যেই নির্মাণ করা হবে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশের সপ্তম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনায় মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পকে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প বা অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাপানের অর্থায়নে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় লক্ষ্যমাত্রায় নির্মাণ হবে এই গভীর সমুদ্রবন্দর। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) জাফর আলম জানান, শুরু থেকেই এ বন্দরে শুল্কায়নসহ কাস্টমস সুবিধা নিশ্চিত করতে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর ভবনে বন্দর-কাস্টমস-জাইকার ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। শুল্কায়ন সুবিধা নিশ্চিতের জন্য মাতারবাড়ীতে ‘কাস্টমস স্টেশন’ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ২০২০ সাল থেকে আসবে কয়লা বোঝাই জাহাজ। চবকের কর্মকর্তারা জানান, বন্দরটির নির্মাণ প্রকল্পের জন্য এরই মধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি, দুটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং এবং একটি এপ্রাইজল মিশন সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসের মধ্যে জাইকার সঙ্গে ঋণ নেগোসিয়েশন কার্যক্রম শুরু হবে। জুনের মধ্যেই হবে ডিটেইল ডিজাইনের (ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন) ঋণ চুক্তি। নকশার কাজে পরামর্শক নিয়োগে এরই মধ্যে আহ্বান করা হয়েছে দরপত্র। মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ চূড়ান্ত করবে চবক। প্রকল্পটিকে ঘিরে ব্যবসায়ী বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক আশাবাদ তৈরি হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নয়া সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম নেতা চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম। সার্ক চেম্বারের এই নেতা মনে করেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে নৌবাণিজ্য পাল্লা দেওয়া, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, শিল্পায়ন ও জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই পোর্ট। ভবিষ্যৎ নৌ-বাণিজ্যের বিশাল কর্মযজ্ঞ সামলাতে গভীর সমুদ্রবন্দরটি বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি মঈনউদ্দিন আহমদ মিন্টুও।

কেন এই মাতারবাড়ী বন্দর : সোনাদিয়ায় অনেকের কাঙ্ক্ষিত গভীর সমুদ্রবন্দর যখন নানা রাজনৈতিক বাস্তবতায় সুদূর পরাহত, তখন কেন এই মাতারবাড়ী পোর্ট— এ নিয়ে অনেকের নানা প্রশ্ন থাকলেও চবক কর্তারা স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে এক ওয়ার্কশপে এই বন্দরটির প্রয়োজনীতার কথা তুলে ধরেছেন। বন্দর কর্মকর্তারা ওয়ার্কশপে জানান, প্রতিবেশী ভারতের জওহরলাল নেহেরু পোর্টে জাহাজ ভেড়ে সর্বোচ্চ ১৩১০০ টিইইউএস কনটেইনার নিয়ে, চেন্নাই বন্দরে কনটেইনার জাহাজ ভেড়ে ৬৮০০ টিইইউএস কনটেইনার নিয়ে, কলম্বো পোর্টে  ১৯২০০ টিইইউএস কনটেইনার নিয়ে জাহাজ ভেড়ে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে আড়াই হাজার টিইইউএসের বেশি কনটেইনার নিয়ে কোনো জাহাজ ভিড়তে পারে না। এ অবস্থায় অধিক ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ার স্বার্থে মাতারবাড়ীতে ডিপ সিপোর্ট নির্মাণ জরুরি।

মাতারবাড়ী বন্দরে চট্টগ্রাম বন্দরের দ্বিগুণেরও বেশি ধারণ ক্ষমতার জাহাজ হ্যান্ডলিং করা যাবে— জানিয়ে চবক কর্তারা বলছেন, এ বন্দরে প্রাথমিক অবস্থায় ৩২০-৩৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি কনটেইনার জেটি এবং একটি মাল্টিপারপাস জেটি নির্মাণ করে বড় মাদার ভ্যাসেল বার্থিং দেওয়া যাবে। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর হবে ১৬ মিটার ড্রাফটের। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৯.৫ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো যায় না। ৮ হাজার টিইইউএস কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে এই সমুদ্রবন্দরে। ফলে সময়ের চাহিদা মিটবে। এই গভীর সমুদ্রবন্দরে আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজ, খোলাপণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাংকারও জেটিতে ভেড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে  চাপ কমবে চট্টগ্রাম বন্দরে। মাতারবাড়ী এবং মহেশখালী অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলগুলোতে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। এই বন্দরে একটি জাহাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি কনটেইনার হ্যান্ডেলিং সম্ভব হবে। এ ছাড়া এই বন্দর থেকে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে দেশের অন্য সব বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ থাকবে।

অবকাঠামোগত বিস্তৃৃতি : প্রাথমিক দুটি ইয়ার্ড নির্মাণের পরেও মাতারবাড়ী বন্দরে থাকবে আরও একাধিক জেটি নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা। কনটেইনারসহ অন্যান্য কার্গোর পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে বন্দরের আয়তন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। যোগাযোগ উন্নয়নে সরকারের নেওয়া ব্যাপক পরিকল্পনার সুফলও পাবেন মাতারবাড়ী বন্দরের ব্যবহারকারীরা। সড়কপথে পণ্য পরিবহনে জাইকার অর্থায়নে সড়ক ও জনপথ বিভাগ মাতারবাড়ী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক এবং রেলপথ বিভাগ ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা ভবিষ্যতে মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গেও যুক্ত হবে। ফলে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর ‘ইন্টারমডাল’ কানেকটিভিটির আওতায় চলে আসবে বলে জানায় চবক।

জাইকা বাংলাদেশ অফিসের রিপ্রেজেনটেটিভ ওয়াথারু ওসাওয়া বলেন, ‘মাতারবাড়ী খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ফলে এখানে সমুদ্রবন্দরও বিশেষ গুরুত্ব পাবে।’ চবক চেয়ারম্যান কমোডর জুলফিকার আজিজ মনে করেন, প্রবৃদ্ধির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়া আরও একটি সমুদ্রবন্দরের বিকল্প নেই। মাতারবাড়ীই হতে যাচ্ছে সেই বন্দর।

প্রকল্প পরিচালক জাফর আলম জানান, বাংলাদেশের উন্নয়নে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।

বন্দর চেয়ারম্যান কমোডর জুলফিকার আজিজ জানান, ‘পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল’, ‘লালদিয়া টার্মিনাল’ ও বে টার্মিনালসহ তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ২০২৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর মাত্র ৭ মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে। অথচ ‘ভিশন-২০৪১’ অর্জন করতে হলে ১৪ মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। জাহাজের সংখ্যা হবে ৮ হাজার ২০০টি। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরের নেই নতুন কোনো জায়গা। বাড়তি সংখ্যক জাহাজ এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আর একটি সমুদ্রবন্দরের বিকল্প নেই। তাই এই সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা জরুরি।

মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে অভিন্ন মত পোষণ করে পিডি জাফর আলম জানান, চট্টগ্রাম বন্দর যে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে, তার জন্য আরও একটি বন্দর প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়তে পারে না। যার ফলে মাদার ভেসেল বন্দরের জেটিতে আসতে পারে না। ফলে ফিডার জাহাজে করে কনটেইনার আনা-নেওয়া করতে হয়। প্রতিদিন ৩৫০০-৩৮০০ টিইইউএস আমদানি পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। কিন্তু মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে ১৬ মিটার গভীরতায় মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ থাকায় এক সঙ্গে ৮ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। একটি জাহাজেই চট্টগ্রাম বন্দরের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে। এর ফলে সেখান থেকে ফিডার ভ্যাসেলের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ থাকবে।

যেভাবে হচ্ছে এই বন্দর : প্রকল্প পরিচালক (পিডি) জাফর আলম জানান, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর জাপানের কাশিমা বন্দর ও নিগাতা (পূর্ব) পোর্টের মডেলের আলোকে নির্মিত হবে। অর্থাৎ সমুদ্রের কিনারায় নয়, চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে বন্দরকে সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। এ ছাড়া চ্যানেলে যাতে পলি জমতে না পারে সে লক্ষ্যে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করে পানির প্রবাহ রোধ করা হবে। চবক জানায়, এ বন্দরটি নির্মাণের লক্ষ্যে মাতারবাড়ীতে ১৬ মিটার ড্রাফট ও ২৫০ মিটার চওড়া একটি চ্যানেল নির্মাণের কাজও চলছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জাইকা এ বন্দর স্থাপনে একটি সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করে। তখন থেকে সেখানে চ্যানেল তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের আগস্টে এ বন্দরের ফিজিক্যাল ওয়ার্ক শুরু হবে। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে একটি টার্মিনাল এবং ২০২৩ সালের শেষে এক মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শেষ হবে।

হাতে হাত ধরে হাঁটা প্রকল্প : গেল ফেব্রুয়ারিতে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে মাতারবাড়ীতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্রকল্পে কয়লা আমদানি ও জাহাজ থেকে কয়লা খালাসের জন্য যে চ্যানেল এবং টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে, সেই একই চ্যানেল ব্যবহার করে মাতারবাড়ীতে একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা তৈরি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ মিটার ড্রাফট এবং ২৫০ মিটার চওড়া একটি চ্যানেল নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাক-সমীক্ষা সম্পন্ন হয়। জাপান সরকারের অর্থায়নেই চবকের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও নির্মাণ করা হচ্ছে।

ফিরে দেখা : চবকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দ্য ইনিসিয়েটিভ অব দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ শীর্ষক উদ্যোগের সূত্রপাত ২০১৪ সালে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরকালে বিষয়টি নিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। সেখানে মহেশখালী এলাকায় বিদ্যুৎ শক্তির উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপান সরকারকে বাংলাদেশের দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার এলাকায় সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরির আহ্বান জানানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ প্রকল্পের ডানায় ভর করেই যেন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি গৃহীত হয়। 

সর্বশেষ খবর