পঞ্চগড় জেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোয় প্রতারকরা রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে একের পর এক স্কুল খুলে চলেছে। এসব স্কুলে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতারকদের হাতে ‘স্থাপিত’ স্কুলগুলোর নাম হচ্ছে— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও শেখ রাসেল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরও অনেক সদস্যের নামে গড়ে উঠেছে বিদ্যালয়। ভাষাসৈনিক, বীরশ্রেষ্ঠ, থেকে জাতীয় কবির নামেও হয়েছে বিদ্যালয়। পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলে গত দুই মাসে হঠাৎ করেই প্রায় ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হারুনর রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নীলফামারী, ডোমার এবং পঞ্চগড়ের অতি উৎসাহী কিছু লোক রাতের অন্ধকারে এসব বিদ্যালয় খাড়া করছেন। এগুলো সমন্ধে স্থানীয়রা যেমন কিছু জানে না তেমনি আমরাও কিছু জানতাম না। আমরা তদন্ত করে দেখেছি এগুলো সরকারি কোনো নীতিমালার আওতায় পড়ে না। এগুলোতে পাঠদানের কার্যক্রম নেই, নামগুলোরও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। লোকজন সঠিক কোনো কিছু না জেনে প্রতারিত হচ্ছে। এ বিদ্যালয়গুলোর কোনোটারই প্রয়োজন নেই বলে আমরা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছি। এসব বিদ্যালয় গড়ে ওঠার ব্যাপারে স্থানীয়রাও খুব বেশি জানেন না। কোনো বিদ্যালয়েই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হদিস পাওয়া যায়নি। ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই। কিন্তু এসব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল দেখানো হয়েছে ২০০৮ সাল।
‘নিয়োগ কবে হবে জানি না’ : বিলুপ্ত ৭৩ নম্বর ছিটমহল সিংগিমারী। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই ছিটমহলে জনসংখ্যা শূন্য। ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা এই ছিটমহলে হঠাৎ করেই টিনের চালা ও বেড়া দিয়ে তিন কামরার একটি ঘর তোলা হয়। স্থানীয়রা জানতে পারে এটি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির আশপাশে কোনো সাইনবোর্ড দেখা না গেলেও একজন মন্ত্রীর ডিও লেটারে জানা যায়, এই বিদ্যালয়টির নাম ৭৩নং সিংগিমারী সজীব ওয়াজেদ জয় প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির ডিজিটাল ব্যানার পাওয়া যায় জমিদাতা গ্রাম্য ডাক্তার ইলিয়াস হোসেনের ওষুধের দোকানে। তিনি জানান, নীলফামারী জেলার জনাব আলী, জাহাঙ্গীর মাস্টার এবং পঞ্চগড়ের রেজাউল করিম তার কাছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ৩০ শতক জমি চান। বিনিময়ে তার ছেলেকে সহকারী প্রধান শিক্ষকের চাকরি দেওয়া হবে। তিনি রাজি হন এবং ঘর তোলার জন্য রেজাউল করিমের হাতে ২৩ হাজার টাকাও দেন তিনি। শিক্ষক নিয়োগ কবে হবে, কমিটি কবে হবে— এসব প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এসবের কিছুই জানি না আমি।
কাগজে আছে বাস্তবে নেই : নাজিরগঞ্জ ছিটমহলে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে বিদ্যালয়ের নাম মন্ত্রী প্রেরিত ডিও লেটারে পাওয়া গেলেও বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে ভাষাসৈনিক বরকতের নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের জমিদাতা হিসেবে মৌখিক নিয়োগ পাওয়া সহকারী শিক্ষক দুলাল হোসেন জানান, দুই মাস আগে ডানাকাটা গ্রামের হায়াত আলীর ছেলে সোহেল রানা আমাকে ৩৩ শতক জমির বিনিময়ে সহকারী শিক্ষকের চাকরি দিয়েছেন। তিনি নিজেও তার জমিতে বীর বিক্রম সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার কাছ থেকে শুনেছি এই বিদ্যালয়ে পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী এখনো ভর্তি করা হয়নি। রাতের অন্ধকারে বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিক কালিয়াগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবদুল হালিম জানান, একটি বিশেষ চক্র রাতের অন্ধকারে এসব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে। চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রায় সাত থেকে আট লাখ টাকা নিচ্ছে। আট লাখ টাকার বিনিময়ে আমার ছেলেকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সাবেক গারাতি ছিটমহল এলাকার হালুয়াপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে মামুন ইসলাম একাই তিনটি বিদ্যালয় স্থাপন করে ১৫ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, আজকাল টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। যখন যা লাগে নিয়োগকৃত শিক্ষকরা তা দেন। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও অফিস সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে একটি প্রতারক চক্র বিভিন্নজনের কাছ থেকে জমি ও লাখ লাখ হাতিয়ে নিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে বোদা উপজেলার বিলুপ্ত নাজিরগঞ্জ ছিটমহলের ডানাকাটা গ্রামের হায়াত আলীর ছেলে সোহেল রানা, সদর উপজেলার ব্যারিস্টারপাড়া গ্রামের রেজাউল করিম, হালুয়াপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে মামুন ইসলাম, নীলফামারী জেলার জনাব আলী এবং জাহাঙ্গীর মাস্টারের নামে। এদের নেতৃত্বেই একটি বড় সিন্ডিকেট এ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। সোহেল রানা জানান, আমি শুধু ঘর তুলে দিয়েছি। সব ব্যাপারে জানেন পঞ্চগড়ের রেজাউল ভাই। রেজাউল করিম মুঠোফোনে বলেন, এ কাজ মন্ত্রী করে দিচ্ছেন। পরবর্তীতে আবার তিনি নীলফামারী জেলার জনাব আলীর মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সব জানতে পারবেন। জনাব আলী ফোন রিসিভ করেননি। এসব বিদ্যালয়কে তৃতীয় ধাপে জাতীয়করণের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একজন মন্ত্রী ও তিনজন সংসদ সদস্য আধাসরকারি পত্র বা ডিও লেটারও পাঠিয়েছেন। ডিও লেটারের কপি দেখিয়ে গত দুই মাসে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে এসব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তির পরপরই ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলোতে। এসব বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছে এবং নিয়মিত পাঠদানও চলছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় একটি এবং দেবীগঞ্জ উপজেলায় পাঁচটি বিদ্যালয়ে পাঠদান চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। দেখা যায়, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য কর্তৃক প্রেরিত সাম্প্রতিক ডিও লেটারগুলোতে পূর্বে প্রতিষ্ঠিত এসব বিদ্যালয়ের নাম নেই। ওইসব ডিও লেটার থেকে জানা যায়, এক মন্ত্রী পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহলে ১১টি এবং লালমনিরহাটে ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তৃতীয় ধাপে জাতীয়করণের প্রস্তাব করেছেন। মহিলা আসন ৩৩৭ এর সংসদ সদস্য ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য হোসনে আরা বেগম ১১টি, ৩১২ আসনের মহিলা সংসদ সদস্য বেগম রিফাত আমিন ১০টি, ৩১৫ নং আসনের মহিলা সংসদ সদস্য ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মমতাজ বেগম ১৩টি বিদ্যালয়কে তৃতীয় ধাপে জাতীয়করণের সুপারিশ করেছেন।