‘ভাই, বুইঝা লন, আমি কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হইছি। দেশে ফিরছি কয় মাস হইলো, কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বামীর কাছে ওই নির্যাতনের কথা বলতে পারি নাই। সৌদি আরবে প্রায় প্রতি রাইতেই বাপ, ছেলে কেউ না কেউ নির্যাতন করত। জমি বেচার টাকা দিয়া স্বামী আমারে ফেরত আনলেও অহন নানা কথা শুনাইতাছে।’ কথাগুলো ময়মনসিংহের নান্দাইলের এক গৃহবধূ বিউটি বেগমের (ছদ্মনাম)। চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে সম্প্রতি প্রাণ নিয়ে কোনোমতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে ফিরে এসেছেন।
হবিগঞ্জের এক কৃষক সৌদি আরব থেকে তিন মাসের মাথায় তার মেয়েকে ফেরত আনার জন্য দালালের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার পরেই তার মেয়েকে ফেরত পান। এই বাবার সান্ত্বনা একটাই যে, অবিবাহিত মেয়েটাকে জীবিত ফেরত পেয়েছেন। গত বছর ফেরার পর থেকে চিকিৎসকের পেছনেই খরচ করতে হয়েছে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। আশপাশের মানুষের কাছ থেকে বাজে মন্তব্য শোনার পাশাপাশি অবিবাহিত আরেক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। সব থেকে ভয় হলো, মেয়ের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তবে সামাজিক বাস্তবতায় মেয়েকে ফেরত পাওয়ার পর আসামি পক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন এ বাবা। কুমিল্লার তাসলিমা আক্তারের বন্দী জীবন কাটছে সৌদি আরবে। তাসলিমা তার বাবার কাছে ফোন করে বলেছে, ‘ওরা আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে আমার লাশটা দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।’ জানা গেছে, দীর্ঘ ১২ বছর আগে বিক্রি হয়ে যাওয়া তাসলিমাকে প্রতিদিন ছয়জন পুরুষের দাসী হয়ে থাকতে হচ্ছে। শুধু তারাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে যাওয়া নারীদের চরম নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দালালদের খপ্পরে পড়ে তাদের জীবন হচ্ছে দুর্বিষহ। জীবন সাজাতে গিয়ে এসব নারী প্রতি মুহূর্তে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে তারা পাড়ি দিয়েছেন সাতসমুদ্র তোরো নদী। কিন্তু হাসি ফোটাতে গিয়ে নিজেদের জীবন এখন বিপন্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দালালদের খপ্পরে পড়ে ভালোভাবে না যেনেই এসব নারী মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন। আর বিপদে পড়ছেন।
কুমিল্লার তাসলিমা আক্তারকে লাকসামের আলম হোসাইন ২০০৭ সালে সৌদি আরব নিয়ে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়। এ ঘটনায় তাসলিমার বাবা আলমসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করে নাঙ্গলকোট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, প্রতারক আলম তাসলিমার ১২ বছরের বেতন বাবদ ৩১ লাখ ৬৮ হাজার টাকাও আত্মসাৎ করেছেন।জানা গেছে, আলম হোসাইন তাসলিমা আক্তার (৩৫), সবুজ খান (৩২) ও ভবানীপুর গ্রামের আলী মিয়ার মেয়ে আমেনা আক্তারকে (৩০) সৌদি আরবে কাজে পাঠানোর কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নেন। তবে তাসলিমা ছাড়া বাকি দুজনকে সৌদি আরব নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেননি আলম। পরবর্তীতে ওই বছরের ৮ জুন তাসলিমাকে সৌদি আরব নিয়ে কয়েক দিন তার বাসায় রেখে তাসলিমার যাবতীয় কাগজপত্র রেখে সৌদি এক নাগরিকের কাছে বিক্রি করে দেন। এরপর থেকে সৌদির ওই ব্যক্তি তাসলিমাকে একটি ঘরে আবদ্ধ রেখে নিয়মিত ছয় ব্যক্তির কৃতদাসের মতো ব্যবহার করতে থাকে। ওই ছয় ব্যক্তি তাকে নিয়মিত দাসীর ন্যায় শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালায়। তাকে শুধু সামান্য কয়টা খাবার খেয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। বন্ধ হয়ে যায় যাবতীয় যোগাযোগ। দেওয়া হয় না তাকে কোনো বেতন। প্রতারক আলম যে সৌদি ব্যক্তির ভিসার মাধ্যমে তাকে কাজের মেয়ে হিসেবে নেয়, তার কাছ থেকে প্রতি মাসে ২২ হাজার (২ হাজার রিয়াল) টাকা নিজ ব্যাংক হিসেবে জমা করেন। এদিকে ১২ বছর ধরে ওই নারীকে নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে ভিসা প্রদানকারী সৌদি ব্যক্তি প্রতারক আলমের বিরুদ্ধে সৌদি আইন অনুসারে মানব পাচার ও বেতনের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে শ্রম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মামলা করেন। মামলার পর আলম সৌদি আরব থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আত্মগোপনে থাকেন। এদিকে গেল সপ্তাহে সৌদি আরব থেকে তাসলিমা অজ্ঞাত এক মোবাইল নাম্বার থেকে তার বাবার কাছে ফোন করে তাকে পাচার ও বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়টি জানান। সেই সঙ্গে জীবিত অথবা মৃত— যেভাবেই হোক তাকে যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করে সে অনুরোধ জানান। কিন্তু সৌদিতে বর্তমানে তার অবস্থান কোথায়, সে বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি তাসলিমা। আর অজ্ঞাত স্থানে থাকার কারণে তার পরিবারের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। বিদেশে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী শ্রমিকদের একটি অংশ দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা অন্যান্য সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, গত দুই বছরে প্রায় তিন হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যা অভিবাসী মোট নারী শ্রমিকের দুই শতাংশের কম। চলতি বছরেও নির্যাতন থেমে নেই। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য বলছে, গত দুই বছরে প্রায় আড়াই লাখ নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে যাওয়া নারীর সংখ্যা ৭০ হাজারের বেশি। এর বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। বিদেশ যাওয়ার পর কোন দেশে কত নারী নির্যাতনের শিকার, এর পুরোপুরি তথ্য বিএমইটির কাছে নেই। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিএমইটি, এনজিওসহ বিভিন্ন জায়গায় নারী শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন। বিএমইটির তথ্য বলছে, গত দুই বছরে প্রায় তিন হাজার নারী বিভিন্ন দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দা এবং ওমানের সেফহোমে আশ্রয় নেওয়া ১ হাজার ৩৬২ জন নারীকে দেশে ফেরত আনা হয়। আর গত বছর এই হোমগুলোয় আড়াই হাজার নারীকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ফেরত আনা হয়েছে ২ হাজারের বেশি নারীকে।