শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-২৩

কারুকার্যখচিত সেই গেটের অজানা তথ্য

মাহবুব মমতাজী

কারুকার্যখচিত সেই গেটের অজানা তথ্য

পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের প্যারিদাস রোডের পেট থেকে শুরু হয়েছে শিরিশ দাস লেন। প্রথমেই হাতের ডানে পড়বে ঐতিহ্যবাহী            বিউটি বোর্ডিং। এর গেট থেকে পাঁচ কদম যেতে দেখা মেলে বিশালাকৃতির দোতলা এক গেট। যার দুই পাশে রয়েছে পুরনো ভবন এবং গেটের উপরেও চারটি থাকার ঘর। এগুলো এখন ফরিদাবাদ পুলিশ ফাঁড়ির ব্যবহূত ঘর। কিন্তু এই গেটটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে চোখের সামনে দুই ধরনের চিত্র ভেসে আসবে।

কারুকার্যখচিত গেটটিতে পাওয়া যাবে নবাবী আমলের ইট। আর উপর অংশের ঘর ও দুই পাশের ভবনগুলোতে পাওয়া যাবে মাটিপোড়া ব্রিটিশ আমলের ইট। মূলত নবাবী আমলের ইটগুলো ছিল চুন-সুরকির তৈরি একটু পাতলা আকৃতির। অথচ এই গেটের তথ্য স্থানীয়দের কাছে আজও অজানা। তবে গেটের কিছু তথ্য মিলেছে ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানীর ইংরেজিতে লেখা ‘ঢাকা’ বইতে।  বই থেকে জানা গেছে, এই গেটটি মুঘল শাসনামলে লক্ষ্মীবাজার এলাকার তৎকালীন জমিদার মির্জা গোলাম মোহাম্মদের বাড়ির। আর বাড়িটি ছিল বর্তমান ১৭ নম্বর কেজিগুপ্ত লেনে। বর্তমানে সেখানে শ্রীশ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ বিগ্রহ মন্দির অবস্থিত। এটি ঘিরে রয়েছে অন্তত ৩৫টি পরিবার। বাসিন্দারাও স্বীকার করেছেন এ বাড়িটি ৩০০ বছরের বেশি পুরনো। ১৭৫৭ সালের পর ইংরেজদের আনুগত্য স্বীকার না করায় মির্জা গোলাম মোহাম্মদকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে বাড়িটি ইংরেজরা দখলে নেয় এবং পরবর্তীতে ভীকম লাল শর্মার কাছে জমিদারিসহ বাড়িটি বুঝিয়ে দেয়। 

সরেজমিন দেখা গেছে, বাড়িটিতে ঢুকতে হয় ছোট একটি দরজা পেরিয়ে। ভিতরটা জরাজীর্ণ হলেও এখনো বেশ গোছানো ছিমছাম। চারদিকে সুনসান নীরব। দরজা পেরিয়ে হাতের বামে পাথর বিছানো সিঁড়ি। উপরে উঠেই হাতের ডানে মন্দির। সামনে ফাঁকা স্থান। যেন এক মিলনায়তন। পাশে একটি পরিবারের বসবাস। মন্দিরের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে পশ্চিমে যেতে আরেকটি ফাঁকা স্থান। এর চারপাশ মিলে আছে আরও কয়েকটি পরিবার। সব গলি, ঘর, ঘরের সামনের ফাঁকা স্থান, কারুকার্যের রেলিং এবং ছাদ ভেদ করা পুরনো গাছ দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়। আর উপরটায় ঘুরতে মনে হয় দোতলায় নয়, মাটিতেই আছি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে এলে বোঝা যায় এটি দোতলা বিশাল বাড়ি। যা বাইরে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৭ সালে বাড়িটিকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে ভাঙার নির্দেশ দেন তৎকালীন ঢাকা জেলা প্রশাসক। এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত হয় সেটি এবং একই বছরের ১৫ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের প্রতি রুল জারি করে উচ্চ আদালত। ২০১০ সালে রাজউক ও ঢাকা সিটি করপোরেশন যৌথভাবে ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের একটি তালিকা করে। সেখানে লক্ষ্মীবাজারের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরটিও রাখা হয়। সর্বশেষ গত বছরের ২৯ নভেম্বর একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। সেখানে ৪৭ নম্বরে রাখা হয়েছে এটিকে। পাতলাখান লেন রোড উল্লেখ করে ভুল ঠিকানা দেওয়া হয়। গেজেটে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনার কাঠামো আংশিক ও সম্পূর্ণ ভাঙার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

মির্জা গোলাম মোহাম্মদের জমিদারিত্বের পর এই মন্দিরের নামেই লক্ষ্মীবাজারের নামকরণ। শুধু লক্ষ্মীবাজারই নয়, ওই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ভীকম লাল শর্মা প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ নগরেরও প্রতিষ্ঠাতা। ভীকম লাল ছিলেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সেনারা ইংরেজদের বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ভীকম লাল শর্মা কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি সরিয়ে নিয়ে কুয়োয় ফেলে দেন। বিদ্রোহ শেষে সেগুলো তুলে ইংরেজদের দেন। তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর চার্জ ক্যালিং সন্তুষ্ট হয়ে তাকে জমিদারি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কথিত আছে— ওয়াইজঘাট এলাকায় ক্যালিং তার মাথার টুপি বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেন। এ সময় তিনি বলেন— তার টুপি যেখানে ঠেকবে সেই এলাকা পর্যন্ত তার জমিদারিত্ব থাকবে। এ জমিদারিত্ব পাওয়ার পর ঘুমের ঘোরে লক্ষ্মীনারায়ণ বিগ্রহের স্বপ্ন দেখেন ভীকম লাল শর্মা। এরপর তিনি কেজিগুপ্ত লেনে পাঁচটি কালো পাথর দিয়ে ওই বিগ্রহ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী পান পুত্র নারায়ণ দাস। এভাবে পর্যায়ক্রমে মন্দিরসহ এ বাড়িটির বৈধ দাবিদার হিসেবে টিকে আছেন অরুণ প্রসাদ পাণ্ডে, রাজেশ পাণ্ডে, দিলীপ গোস্বামী ও শ্যামল গোস্বামী।

 

অরুণ প্রসাদ পাণ্ডে এ প্রতিবেদককে বলেন, ভীকম লালের বৈধ উত্তরসূরি হিসেবে আমরা চার পরিবার এখন এখানে বসবাস করছি। বাকি সব দখলদার। তারা প্রথমে ভাড়া নেওয়ার কথা বলে বাসাগুলোতে ওঠে। কয়েক মাস ভাড়া দেওয়ার পর তা বন্ধ করে দেয়। উল্টো বলে, এটি মন্দিরের জায়গা, কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। তাই তারা ভাড়া দেবেন না। তিনি জানান, ভীকম লাল এ বাড়িটি ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন এবং স্বপ্ন দেখার পর তিনি ব্যক্তিগতভাবে বাড়ির দোতলায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এ বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে রাজউকের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর