রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিরপরাধীর পকেটে অপরাধীর মাদক

মির্জা মেহেদী তমাল

নিরপরাধীর পকেটে অপরাধীর মাদক

একটি ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ সোহেল আহমেদ। তিনি তেজগাঁও এফডিসি গেটের সামনে দিয়ে  মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন ধানমন্ডিতে। সোনারগাঁও মোড়ের সিগন্যালে আটকে পড়েন তিনি। এ সময় এক যুবক তার সামনে এসে দাঁড়ায়। দুই হাতজোর করে বলে, ‘ভাই আমার স্ত্রী হাসপাতালে। আমাকে একটু পান্থপথের চৌরাস্তা পেরিয়ে নামিয়ে দিলেও চলবে।’ হাসপাতালের কথা শুনে সোহেল আহমেদের মায়া হয়। তিনি যুবকটির চেহারায় একবার তাকিয়েই বলেন, ‘ঠিক আছে ওঠেন। আমি ওই রাস্তা হয়ে ৩২ নম্বর সড়কের দিকেই যাচ্ছি।’ যুবকটি দ্রুত সোহেলের মোটরসাইকেলে চেপে বসে। সিগন্যাল ছেড়ে দিলেই মোটরসাইকেল চলতে শুরু করে। সার্ক ফোয়ারা ক্রস করতেই সোহেল আহমেদ অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। পেছনে বসা লোকটি নড়ছিল এবং খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে। সোহেল আহমেদ কিছু বললেন না। আরেকটু এগিয়ে যেতেই সোহেলের মনে হচ্ছিল তার পেছনে প্যান্টের বেল্ট ধরে আছে লোকটি। সোহেল অবাক হন। কী ব্যাপার? লোকটি কী করতে চাচ্ছে। তবে সোহেল স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, তার পেছনে প্যান্টের বেল্টের কাছে কিছু একটা রাখা হয়েছে। যে কারণে সেখানটায় কেমন যেন লাগছিল। পান্থপথের চৌরাস্তায় আসার আগে আবারও ট্রাফিক জ্যামে পড়েন সোহেল। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ তিনি মোটরসাইকেল সাইড করে থামিয়ে দেন। তিনি তার পেছনে বসা লোকটিকে বলেন, ‘ভাইয়া আমি সরি। আমার একটা জরুরি কাজ পড়ায় মোটরসাইকেলটি ঘুরিয়ে ফেলতে হচ্ছে। এখন আপনি কষ্ট করে চলে যান।’ লোকটি মোটরসাইকেল থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই সোহেল নিজের প্যান্টের পেছনে বেল্টের দিকে হাত দেন। হাতে কিছু একটা বাজছিল। দুই আঙ্গুল দিয়ে সেটা এনে দেখেই তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। ভাবছিলেন, কী ব্যাপার! দুই পিস ইয়াবা এলো কোথা থেকে। তিনি তো এই  মাদক কখনো গ্রহণ করেননি। তবে কীভাবে এলো? হঠাৎ সেই লোকটির কথা মনে পড়ল। যাকে তিনি সাহায্য করতে বাইকে তুলে নিয়েছিলেন। লোকটির কথা মনে পড়তেই তিনি আশপাশে মাথা ঘোরান। আরে লোকটি নেই। সোহেল বুঝতে পারেন কাজটি হয়তো সেই লোকটি করেছে। পান্থপথের চৌরাস্তার পশ্চিম পাড়েই ছিল পুলিশের চেকপোস্ট। সেই চেকপোস্ট টার্গেট করেই হয়তো লোকটি তার প্যান্টে দুই পিস ইয়াবা প্যান্টের পেছনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সোহেল ভাবছিলেন, বাইক নিয়ে রাস্তাটা ক্রস করলেই হয়তো তাকে তল্লাশি করা হতো। তল্লাশি করেই তার কাছ থেকে পুলিশ খুঁজে পেত ইয়াবা। হয়তো কাউকে বিশ্বাস করানো যেত না, তিনি ইয়াবা সেবনকারী নন।

বাইকের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, যাত্রীবাহী বাসে ভিড়ের মধ্যে টার্গেট করা যাত্রীর পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইয়াবা। আর যে স্টপেজে যাত্রী নেমে যাবেন, সেই স্টপেজেই ওতপেতে থাকছে শিকারি। তারা কখনো পুলিশ আবার কখনো ভুয়া পুলিশ। বাসের মধ্যে একটি টিম যাত্রীকে টার্গেট করে ইয়াবা পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। তারা লক্ষ্য রাখে কোন স্টপেজ পর্যন্ত ভাড়া দিয়েছেন সেই যাত্রী। সেই স্টপেজেই ফোনে প্রস্তুত থাকতে বলা হয় বাসের ভিতর থেকেই। বাস থেকে নামার পর নিরীহ সেই যাত্রী পড়েন তল্লাশির মধ্যে। পকেট থেকেও খুঁজে পাওয়া যায় ইয়াবা। অস্বীকার করার কোনো উপায়ও থাকে না। বাধ্য হয়েই তাকে সমঝোতায় যেতে হয়। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সেই যাত্রা থেকে রক্ষা পেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাসে ওঠে প্রত্যেক যাত্রীকেই অ্যালার্ট থাকতে হবে। নানা ধরনের প্রতারক ঘুরছে চারদিকে। এদের কাছ থেকে রক্ষা পেতে আগে নিজেদের সচেতন হতে হবে। রাস্তায় কেউ বললেই বাইকে তুলে নেওয়া ঠিক নয়। বাস বা মোটরসাইকেল বাদেও পথে-ঘাটে ঘটছে এমন ঘটনা। রাস্তায় পুলিশ তল্লাশি চালায় মানুষের পোশাক, দেহে। এ সময় এক শ্রেণির পুলিশ সদস্য পকেটে হাত ঢুকিয়েই বলে এই যে ইয়াবা। পকেট থেকে মুষ্টিবদ্ধ হাত বের করে এবং প্রকাশ্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলে দেয়। তখন দেখা যায় তার হাতে ইয়াবা ট্যাবলেট। এমন ঘটনা ঘটছে রাজধানীসহ সারা দেশে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নিয়ে পুলিশও গণপিটুনির শিকার হয়েছে। পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে চাঁদাবাজি করছে পুলিশ। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অহরহ শোনা যাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই পুলিশ এই ধরনের কাণ্ড করে চলেছে। পুলিশের এভাবে টাকা আদায়ের বিষয়টি এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠছে। পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির এমন অভিযোগ প্রতিকারে কার্যকর ব্যবস্থা তেমন নেই বললেই চলে। মিরপুরের ১৩ নম্বর এলাকায় পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে প্রলয় বৈদ্য নামে এক যুবকের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে পুলিশ। প্রলয় সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সুনীল কুমার বৈদ্যের  ছেলে। অভিযোগ ওঠে, কাফরুল থানার এএসআই আমিনুল ইসলামের লোকজন তল্লাশির নামে প্রলয়ের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দেন। ইয়াবা ব্যবসায়ী সাজিয়ে প্রলয়কে আটক করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন আমিনুল। পরে ওপর মহলে বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে  ছেড়ে দেওয়া হয়।

পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে চাঁদাবাজির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে চট্টগ্রামে। ইয়াবা ট্যাবলেট সাধারণত মিয়ানমার  থেকে আসে। কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত পথে ইয়াবার মতো ভয়াবহ মাদক বাংলাদেশে ঢুকছে। এ কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় অধিকাংশ ইয়াবাকেন্দ্রিক অপরাধের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে ইয়াবা বাণিজ্যের বেশ কয়েকটি ঘটনায় একাধিক পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার ও বিভাগীয় শাস্তির মুখে পড়েছেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে পটিয়া থানার এসআই নাদিম মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি ইয়াবা দিয়ে নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে টাকা আদায় করেন। ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় পুলিশের তিন এসআইয়ের কাছ থেকে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় এসআই শাহাদাত  হোসেন, জুয়েল সরকার ও শেখ সজীবের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজির ঘটনা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরেও একইভাবে ঘটে চলেছে। ২০১৭ সালের ১৭ জুন একজন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীকে  ডেকে নিয়ে পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টার অভিযোগে যশোরে সিরাজুল ইসলাম নামের এক পুলিশ সদস্যকে গণধোলাই দেয় জনতা। যশোরের সদর উপজেলার সাতমাইল বাজারে এ ঘটনা ঘটে। মোবাইল  ফোন ব্যবসায়ী পিকুল অভিযোগ করেন, সন্ধ্যার আগে তিনি বাজারের সিকদার হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।  সে সময় সাদা পোশাকের কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম কথা আছে বলে তাকে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে গিয়ে তার পকেটে একটি পলিথিনের প্যাকেটে মোড়ানো ৩-৪টি ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করলে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে যায়। তখন  লোকজন কনস্টেবল সিরাজের হাতে ইয়াবা ট্যাবলেট  দেখতে পান। অবস্থা বেগতিক দেখে কনস্টেবল সিরাজ  ফোন করে কোতোয়ালি থানার এসআই  মোখলেসুজ্জামানকে সংবাদ দেন। সে সময় আরেক এসআই আবুল কালাম আজাদ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ লাইনে নিয়ে যায়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, এমন অভিযোগ আমরাও পাচ্ছি। কক্সবাজার এবং কাশিমপুর জেলখানা পরিদর্শনে গিয়ে এমন অনেক বন্দীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি। তাদের পকেটে মাদক দিয়ে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। এসব বিষয়গুলো পুলিশকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। অবশ্যই গুরুত্ব দিয়েই বিষয়টি দেখতে হবে। ১০ বছর আগে তো এমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এখন কেন পাওয়া যাচ্ছে। ঘটনা ঘটছে বলেই তো অভিযোগ আসছে।

৯৯৯ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে পুলিশের সহযোগিতা নিতে হবে সাধারণ মানুষকে। এক্ষেত্রে তারা ৯৯৯-এ কল করে দ্রুত সেবা পেতে পারে। তারা এভাবে চাঁদাবাজি করলে এই হটলাইনে কল করলে দ্রুত পুলিশ পাঠানো সম্ভব হবে।

সর্বশেষ খবর