রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

যমুনায় বালুচর, মরছে চলনবিল

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। অথচ অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে নদী। নদী বাঁচাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ৩২তম পর্ব আজ।

আবদুস সামাদ সায়েম, সিরাজগঞ্জ

যমুনায় বালুচর, মরছে চলনবিল

রক্ষণাবেক্ষণে নজর না থাকায় সিরাজগঞ্জসহ সংলগ্ন বিশাল এলাকা জুড়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী চলনবিল মরা বিলে পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি যমুনা নদীর বুকে দেখা দিয়েছে ধু-ধু বালুচর। জানা গেছে, সড়ক-মহাসড়ক, অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, কালভার্ট, স্লুইসগেট, ক্রসবাঁধ তৈরিসহ দখল-দূষণে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে চলনবিলের আয়তন হ্রাস পেয়ে চলেছে। বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছোটবড় ৪০টি নদী ছিল সিরাজগঞ্জ তথা চলনবিলের প্রাণ। কালের বিবর্তনে ২৪টির অস্তিত্ব এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। বাকিগুলোর মধ্যে করতোয়া, ইছামতি, গুমানী, গোমতী, আত্রাই, ভদ্রাবতী, গোহালা, বড়াল, নন্দকুজা, গাড়াদহ, কাকন-কানেশ্বরী, স্বরসতী, মুক্তাহার, ঝবঝবিয়া ও ফুলজোড়ও এখন মৃতপ্রায়। আরেকদিকে জেলার পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর বুকে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠে যমুনা তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। ক্রমশ নদীটি পশ্চিম তীরে অবস্থিত সিরাজগঞ্জ ও পূর্ব তীরে অবস্থিত টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর-তারাকান্দি-চৌহালী উপজেলার দিকে ঢুকে পড়ছে। গ্রাস করছে বসতভিটা-ফসলি জমি। নিঃস্ব করে ফেলছে হাজার-হাজার পরিবারকে। যা দুই পাড়ের মানুষের জন্য অশনিসংকেত। এ ছাড়াও বেলকুচি-শাহজাদপুরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক হুরাসাগরটিও মরাখালে পরিণত হয়েছে। সেইসঙ্গে বিলুপ্তির পথে রয়েছে মত্স্য সম্পদ। এক সময় যমুনা ও চলনবিলের মাছ উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়েও ভারতে রপ্তানি হতো। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম ও নওগাঁর আত্রাই নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮ বর্গকিলোমিটার। এ বিলের সঙ্গে যুক্ত ছিল ৩৯টি বিল, ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ছোট-বড় প্রায় ৪০টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল। খালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিমাইচড়া খাল, নবীর হাজির জোলা, বেশানীর খাল, হক সাহেবের খাল, উলিপুর খাল, গুমানী কাল, কুমারভাঙ্গা খাল, গাড়াবাড়ি খাল, জানিগাছার জোলা, কিনু সরকারের ধর ও সাত্তার সাহেবের খাল।

১৯০৯ সালের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে সিরাজগঞ্জ হতে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের ফলে বিলের অপেক্ষাকৃত উঁচু উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহে ভাটা পড়ে। এরপর থেকেই চলনবিলের আয়তন সংকীর্ণ হতে শুরু করে। এ ছাড়া পদ্মার পলি জমে গত কয়েক দশকে বিলের দক্ষিণাংশের প্রায় ২১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা শুকিয়ে গেছে। চলতি দশকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণের পর পানি প্রবাহে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফলে বিলের দেশীয় প্রজাতির প্রায় ৫০ প্রকার মাছের অধিকাংশই বিলুপ্তি ঘটেছে। বিলুপ্ত প্রায় এসব মাছের মধ্যে রয়েছে কই, শিং, মাগুর, কাঁকিলা, শোল, বোয়াল, চিতল, মোয়া, হিজল, তমাল, জারুল বাতাসি, টেংরা, গোলসা, নন্দই, পুঁটি, সরপুঁটি, খলিশা, চেলা, ডানকানা, টাকি, বাইটকা, বাউস, কালোবাউস, চ্যাকা, বাইম, বউমাছ, গোঁচৌ, গোরপুইয়া, কুচিয়া, কচ্ছপ, কাছিম ও কাঁকড়া ইত্যাদি। প্রবীণেরা বলেন, এ বিলে মাছ আর পানি যেন ছিল সমান সমান। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক শুঁটকি উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু শুঁটকি সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমানে এর উৎপাদনও কমে গেছে।

যমুনার বুকে ধু-ধু বালুচর : বর্ষা মৌসুমের করালগ্রাসী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণকারী যমুনা বর্তমানে নাব্য হারিয়ে মরাখালে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই যমুনার বুকে কচ্ছপের পীঠের মতো অসংখ্য ছোট-বড় ডুবো চর জেগে উঠেছে। চরের ফাঁকে ছোট-ছোট চ্যানেলগুলো মানুষ হেঁটে হেঁটেই পার হচ্ছেন। একসময় সিরাজগঞ্জ জগন্নাথগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল, ভুয়াপুর, টাঙ্গাইল-বেলকুচিতে স্টিমার-লঞ্চ চলাচল করত। কিন্তু পলি পড়ে চর জেগে ওঠায়  নৌরুটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মাঝ নদীতে বিশাল চর জেগে ওঠায় নদীর গতিপথে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ক্রমশ যমুনা নদী পশ্চিম তীরে অবস্থিত সিরাজগঞ্জ ও পূর্ব তীরে অবস্থিত টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর-তারাকান্দি-চৌহালী উপজেলার দিকে ঢুকে পড়ছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশালী আরিফুল ইসলাম জানান, টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যমুনার প্রস্থ স্থানভেদে ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার। সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮২ কিলোমিটার। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে লাখ লাখ টন পলি পড়ে। এ জন্য স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে যমুনার বুকে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। ফলে নদীটি আকা-বাকা ও বিভিন্ন চ্যানেল বিভক্তি হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বড় দুটি চ্যানেল পুর্ব-পশ্চিম তীর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তীর এলাকাগুলো ভাঙনের মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীটি এক চ্যানেলে রূপান্তর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ড্রেজিংয়ের জন্যও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও আভ্যন্তরীন নদীগুলো খননের জন্যও প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ৮২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের যমুনা নদীর ৪০ কিলোমিটার এলাকার তীর অরক্ষিত রয়েছে। তীরসংরক্ষণ এবং এক চ্যানেল করা হলে আর ভাঙন দেখা দেবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর