রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী শঙ্খনিধি বাড়ি

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-৩১

মাহবুব মমতাজী

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী শঙ্খনিধি বাড়ি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সেনাবাহিনীতে বাঙালির উপস্থিতি ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। ১৯১৬ সালের ৭ আগস্ট গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ঢাকা শহরে বাঙালিদের জন্য একটি পদাতিক রেজিমেন্ট বা পল্টন গঠনের ঘোষণা দেন। এটি পরে ‘৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’ বা ‘বাঙালি পল্টন’ নামে পরিচিতি পায়। ১৯১৭ সালে গৌরনিতাই শঙ্খনিধির বাড়িতে বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কমিটির ঢাকা শাখা গঠিত হয়। এতে জেলা কালেক্টর এস জি হার্ট সভাপতি, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদক ও গৌরনিতাই শঙ্খনিধি কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন বলে জানা যায়। ইতিহাসের সাক্ষী শঙ্খনিধির সেই দোতলা বাড়িটি আজও আছে। এটি পুরান ঢাকার ৩৮ নম্বর টিপু সুলতান রোডে অবস্থিত। বাড়িটিতে গোথিক-ইন্ডিয়ান ও ইন্দো-সারাসিনি রীতির প্রভাব দেখা যায়। এর সামনের অংশে একটি কারুকাজ করা সুদৃশ্য ফটক। মাঝে ষড়ভুজাকৃতি স্তম্ভ। ভবনের দুই পাশে তিনটি করে প্রবেশপথ। জরাজীর্ণ হলেও দেয়ালের পলস্তারায় দৃষ্টিনন্দন লতাপাতা ও ফুলের নকশা এখনো নজর কাড়ে। ভবনের উত্তর দিকে ছিল একটি মন্দির। যেটিকে রাধাকৃষ্ণ, রাধামাধব ও রাধাগোবিন্দ মন্দির নামে অবহিত করা হতো বলে জানা গেছে। এই শতবর্ষী বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ঐতিহ্যবাহী ৩২টি ভবনের এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৯৩টি ঐতিহাসিক নান্দনিক ভবনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। সর্বশেষ গত বছরের ২৯ নভেম্বর রাজউক ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকার একটি গেজেট প্রকাশ করে। এখানে শঙ্খনিধির বাড়ি ও মন্দিরটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে শঙ্খনিধি বাড়ি দখলদারদের কবলে পড়ে নিজের জৌলুস হারিয়ে কোনোমতে টিকে আছে। দখলদারদের কেউ কেউ গ্যারেজ ও দোকানপাট বসিয়েছেন, কেউবা সপরিবারে বসবাস করছেন। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দখলদাররা উত্তর দিকের মন্দির ভাঙতে শুরু করেন এবং দোতলার ছাদ সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলেন। পরে আদালতে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভাঙা বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু চুপিসারে সেই ভাঙা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন জায়গাটির দাবিদার ৪৪ নম্বর র্যাংকিং স্ট্রিটের রেশমা ভিলার মালিক আশরাফ আলী। তিনি প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছেন মন্দিরটি। তবে মন্দিরের তালাবদ্ধ দরজাটি এখনো আছে। এ বিষয়ে জানতে রেশমা ভিলায় আশরাফ আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, অনেকটা জাল-জালিয়াতি করে আশরাফ আলী মন্দিরের জায়গাটির মালিকানা ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে নিয়েছেন। প্রথমে ঐতিহবাহী ভবনের তালিকায় রেখে পরে বাদ দেওয়ার ঘটনাটি ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য ধ্বংসের এক ষড়যন্ত্র। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯০০ সালের শুরুর দিকে লালমোহন সাহা, বণিক ভজহরি সাহা বণিক ও গৌরনিতাই সাহা বণিক ব্যবসায় বেশ উন্নতি লাভ করেন। বিত্তশালী হওয়ায় তারা বণিক উপাধি বর্জন করে শঙ্খনিধি বা শঙ্খের বাহক উপাধি গ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে টিপু সুলতান রোডে শঙ্খনিধি হাউসের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভবনের হিন্দু অধিবাসীরা ভারতে চলে গেলে ভবনটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিকারে চলে যায়। ১৯৮০ সালে শঙ্খনিধি হাউস প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে শঙ্খনিধি হাউসের একাংশ ও নাচঘর ভেঙে ফেলা হয়। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শরিফ রায়হান কবির বলেন, মন্দিরটি কীভাবে ভাঙা হলো এবং অন্য ব্যক্তিরা কীভাবে বাড়িটি ব্যবহার করছেন সে সম্পর্কে আমি পূর্ণাঙ্গ অবগত নই। জানা যায়, শঙ্খনিধি বাড়ির ভিতরে উত্তর পাশে এক তলা মন্দির ছিল। এটি আয়তাকার, সুসজ্জিত ও দক্ষিণমুখী। এর ৬০ ফুট বাই ৫০ ফুট দীর্ঘ আঙিনা। অন্য তিন দিকের ভবন দ্বিতলবিশিষ্ট। সামনে চারটি করিনথিয়ান স্তম্ভ ও মাঝখানে তিনটি সুসজ্জিত তোরণ। এই সুদৃশ্য মন্দিরের বিভিন্ন পাশে নানারকম লতাপাতার কারুকাজ; যার মধ্যে শঙ্খনিধি পরিবারের প্রতীক শঙ্খের বিভিন্ন নকশা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যেত। শঙ্খনিধি বাড়ির ভিতরে অবস্থিত বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির কার্যালয়। এর অফিস সেক্রেটারি মোশাররফ হোসাইন মীর জানান, এ বাড়ির উত্তর দিকে মন্দিরকে আমরা দেখেছি। পাশের বাসার মালিক তার জায়গার দাবি করে তা ভেঙে ফেলেছেন। আর গ্যারেজ ব্যবহূত হচ্ছে ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে লিজ নিয়ে।

সর্বশেষ খবর