শনিবার, ১২ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

হ্যালো, টাকা পাঠান

মির্জা মেহেদী তমাল

হ্যালো, টাকা পাঠান

ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে একজন বলতে শুরু করলেন— ‘হ্যালো ইঞ্জিনিয়ার সাব! মালপাত্তি ভালোই কামাইতাছেন। খুব ভালো। কিন্তু ভাই বেরাদারগো খবর রাখবো কে? যাই হোক এতো কথা ভালো লাগে না। সোজা সাপ্টা কথা কই। আমি আসলাম বলছি। সুইডেন আসলাম। জেলখানা থেকে বাইর হওয়ার প্রোগ্রাম হইছে। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়। টাকা লাগবো। লাখ পাঁচেক দিলেই হইবো তাড়াতাড়ি। আজ বিকালের মধ্যে লাগবো। লোক পাঠামু। দিয়া দিয়েন। পুলিশ র্যাবের কাছে আওয়াজ দিলে আপনার কিছু হবে না। পরিবারের লাশ পড়বো। মনে রাইখেন। ’

প্রকৌশলী রায়হান অজ্ঞাত ব্যক্তির এমন একটা ফোন কল পেয়ে তার শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। টেনশন করছেন। কী করবেন, কাকে বলবেন, বুঝতে পারছেন না। পুলিশকে জানালে বলছে পরিবারের লাশ পড়বে। ঘামতে শুরু করেন। কাউকে তিনি বলছেন না। বিকালে আবারও ফোন। এবার অন্য কণ্ঠ। ‘হ্যালো ভাইজান! সুইডেন ভাই বলছিলো আপনি পাঁচ লাখ টাকা দিবেন। কোথায় আসবো তাড়াতাড়ি বলেন। আমাদের সময় নেই। প্রকৌশলী রায়হান এ কথা শুনে কিছু বলতে পারছেন না। তিনি তো বলেননি, টাকা দেবেন। এখন অজ্ঞাত ব্যক্তি বলছে, কোথায় আসবে সে টাকা নিতে। সাহস করে রায়হান বললেন, ভাই আমি বলিনি টাকা দিবো। টাকা আমার কাছে নেই। ওপাশের লোকটি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে। অকথ্য গালাগাল দিয়ে বলছে, ওই বেডা তুই টাকা দিবি কইছস। এখন কস, বলিস নাই। আইজ তগো লাশ পড়বো। তরেও মারুম।’ রায়হান অনুনয়-বিনয় করে বলেন, ভাই আমার কাছে টাকা নেই। আচ্ছা দুই এক লাখ টাকা কম দিস-ওপাশের লোকটি বলে। রায়হান বলেন পারবেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দর কষাকষি চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৫ হাজার টাকায় রফাদফা হয়। একটা বিকাশ নম্বরে ১৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন রায়হান। ভাবছেন, বড় বাঁচা তিনি বেঁচেছেন। সেদিনই রায়হান তার এক পরিচিত পুলিশ অফিসারের কাছে জানান। সেই পুলিশ অফিসার নম্বরগুলো ট্রাকিং করে দেখেন একটি নম্বরও জেলাখানা বা আশপাশ এলাকার নয়। ঢাকার ভিতরের। রায়হান বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এমন ঘটনা ঘটছে রাজধানীসহ সারা দেশেই। রাজধানীবাসীর কাছে নামেই যারা মূর্তিমান আতঙ্ক তাদের অনেকেই নিহত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময়, ক্রসফায়ারে। আর কেউবা আছেন কারাগারে। ক্রসফায়ার ও গ্রেফতার থেকে রক্ষা পেতে ধূর্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই আত্মগোপনে থাকার জন্য পাড়ি দিয়েছেন দেশের বাইরে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তাদের প্রথম পছন্দ হলেও কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকা, কানাডা, নেপালসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। তারপরও তাদের নামে চলছে নীরব চাঁদাবাজি। পুলিশ বলছে, এসব ক্ষেত্রে অযথাই মানুষ আতঙ্কিত হয়। তারা পুলিশকে সময় মতো জানালেই সমস্যায় পড়বে না। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, একটি প্রতারক চক্র দীর্ঘদিন ধরেই ভয় দেখিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদাবাজি করছে। বিকাশ, কালা জাহাঙ্গীর, সুব্রত বাইনসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে চক্রটি। ২০০১ সালে জোট সরকারের সময় সন্ত্রাস দমনে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরে ২০০৪ সালে র্যাব গঠন করে দায়িত্ব দেওয়া হয় সন্ত্রাস দমনের। র‌্যাবের অভিযানে একের পর এক গ্রেফতার এবং ক্রসফায়ারের ঘটনায় গাঢাকা দেন ধূর্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা। অনেকেই চলে যান দেশের বাইরে। তবে এদের অনেকেই কারাগার ও দেশের বাইরে থেকেই চালাচ্ছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। তবে ২০০১ সালের পর দীর্ঘ ১৫ বছরে নতুন কোনো তালিকাও প্রকাশ হয়নি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের। এই সুযোগে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনে দিনে অপরাধ জগতের চুনোপুঁটিরা হয়ে উঠেছে বিভিন্ন এলাকার নতুন আতঙ্ক। মিরপুরে রিয়াজ উদ্দিন (ছদ্মনাম) নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে শাহাদাতের হয়ে সাড়ে ৯ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। না হলে প্রাণে মারার হুমকি দেওয়া হয়। তাত্ক্ষণিকভাবে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকার জন্য সময় নেন রিয়াজ উদ্দিন। পরে র‌্যাবকে ঘটনা জানিয়ে সহযোগিতা চান। র‌্যাবের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সেই চাঁদার অর্থ আনতে গিয়ে ধরা পড়ে ইয়ামিন সরকার ওরফে মন্টি, সেন্টু মিয়া, বাবু আহমেদ, ?মিলন ওরফে সুমন, সোলাইমান কাদের ওরফে পাভেল ও মাসুদ রানা ওরফে রানা নামে শাহাদাতের ছয় সহযোগী। কারাবন্দী সহযোগীদের ছাড়াতে সোনালী ব্যাংকের এক কর্মকর্তার কাছে ফোনে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে তাকে ব্যাংক বা বাসা থেকে তুলে নেওয়ারও হুমকি দেয় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে ওই কর্মকর্তা মতিঝিল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। থানা তার অভিযোগটি জিডি হিসেবে নথিভুক্ত করে। র‌্যাবের গণমাধ্যম ও আইন শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে ফোনে এক সময় চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেলেও বেশ কিছুদিন তেমন কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না। র‌্যাব সৃষ্টির পর থেকেই সন্ত্রাস দমনে কাজ করে যাচ্ছে। এখনও থেমে নেই। তবে দেশে এখন শীর্ষ সন্ত্রাসী নেই। নতুন পুরনো আলাদা কথা নেই। যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ পাওয়া যায় র‌্যাব তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর