সোমবার, ১৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

উদ্ধারের ফাঁদে নিখোঁজ পরিবার

মির্জা মেহেদী তমাল

উদ্ধারের ফাঁদে নিখোঁজ পরিবার

সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান এ টি এম রিয়াদ। বিকালে ফেরার কথা থাকলেও ফিরেননি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছেন রিয়াদের বাবা মা। বিকাল থেকেই তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ রয়েছে। কী হতে পারে, বুঝতে পারছেন না তারা। পথে কোনো বিপদ আপদ হলো না তো! এমন ভাবনায় অস্থির সবাই। কারণ তার পকেটেও টাকা ছিল। নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। ব্যবসার তিন লাখ টাকা নিয়ে গুলশানের অফিস থেকে বেরিয়েছেন তিনি। অফিস থেকে এমন তথ্য পেয়েছেন তারা। তবে কোথায় গেল রিয়াদ রাত বাড়ছে।

বাড়ছে তাদের ভয়। ছেলের কী হলো? বিভিন্ন স্থানে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছেন পরিবারের সবাই। খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজনরাও আসতে শুরু করেছেন রিয়াদদের যাত্রাবাড়ীর বাসায়। থানা, গোয়েন্দা দফতর, র‌্যাব, হাসপাতাল, মর্গ-কিছুই বাদ রাখা হচ্ছে না। কিন্তু কেউ কোনো খবরও দিতে পারছেন না। বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেন রিয়াদের বাবা। নির্ঘুম রাত কাটে পুুরো পরিবারের। হাহাকার চলছে। কান্নাকাটি করছেন মহিলারা। সকাল হয়। নতুন উদ্যোমে খোঁজ খবর চলছে।

দুদিন পেরিয়ে গেছে রিয়াদেও খোঁজ মিলেনি। সংবাদপত্রে রিয়াদের ছবি দিয়ে নিখোঁজ সংবাদ দেওয়া হলো। তাতে দেওয়া আছে একটি ফোন নম্বর। সহৃদয়বান কোনো ব্যক্তি তার খোঁজ পেলে যেন ওই নম্বরে যোগাযোগ করেন। আর এ জন্য পুরস্কার দেওয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে।

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার পরও কোনো খবর হচ্ছে না রিয়াদের। বিকালে বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নম্বরটিকে কল আসে। ফোনটি ধরেন রিয়াদের বাবা। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে এক ব্যক্তি নিজেকে শাহিন বলে পরিচয় দিয়েই কথা বলতে থাকেন। লোকটি বলেন, রিয়াদ আপনার কী হয়? রিয়াদের বাবা এ সময় অস্থির হয়ে ওঠেন। বলেন, হ্যাঁ, আমার ছেলে। কেন বাবা, রিয়াদ কোথায়? আমাকে একটু রিয়াদকে দেওয়া যাবে? ওপাশের লোকটি এ সময় খুব তাড়াতাড়ি কথা বলতে শুরু করে। রিয়াদ নামে এক যুবককে পাওয়া গেছে রাস্তার ধারে। এ কথা বলার পরই ফোনের লাইন কেটে যায়। রিয়াদের বাবা নিজেই ফোন দেন। কিন্তু ফোনটি কেউ ধরছেন না। বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর হঠাৎ ফোনটি সেই আগের লোকটি রিসিভ করেন। বলেন, ‘আরে ভাই আমি ব্যস্ত। এদিকে আপনার ছেলেকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। কেউ তাকে ধরতে চায় না। আমি নিজেই তাকে ধরে গাড়িতে ওঠাই। এখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন, কন্ডিশন ভালো না। ঢাকায় নিতে হবে। কিন্তু ভাই, যতটুকু করেছি, অনেক করেছি। আমার কাজ আছে।’

রিয়াদের বাবা এসব শুনে ঘাবড়ে যান। বলেন, ‘যেভাবেই হোক আমার ছেলেকে বাঁচাতে হবে।’ তখন ওই লোকটি বলেন, ‘দেখেন আমার কাজ আছে। আপনাদের ছেলেকে নিয়ে আটকে গেছি। মানবিকতা দেখাতে গিয়ে আমারই ক্ষতি হচ্ছে। আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। আপনারা পারলে আসেন। এটা কুমিল্লা। এখানে এসে ফোন দিলে পাওয়া যাবে। আর না হয়, আপনাদের জন্যে একটা কাজ করতে পারি। এখান থেকে একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেই। শুনে তখন রিয়াদের বাবা মহাখুশি। বলেন, ‘আপনি অনেক কষ্ট করছেন। কেউ এমন করে না।’ তখন লোকটি তাকে বলেন, ‘তাড়াতাড়ি এ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া পাঠিয়ে দেন। আর আপনাদের ছেলের চিকিৎসায় এখানে আমার পকেট থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এটা না হয় ঢাকায় এ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই চলবে। কিন্তু এখন এ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার টাকাটা পাঠিয়ে দেন তাড়াতাড়ি। না হয়, আমি এখান থেকে আমার কাজে চলে যাব।’ রিয়াদের বাবা অনুনয় বিনয় করে তাকে থাকতে বলেন। তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে দোকানে গিয়ে ৫ হাজার টাকা বিকাশ করেন তিনি। টাকাটা পেয়েছেন কিনা কনফার্ম করতে রিয়াদের বাবা ফোন করেন। ওই লোকটি নিশ্চিত করেন টাকা পাওয়ার বিষয়টি। এরপর আবারও যখন ফোন দেন রিয়াদের বাবা, তখন আর ফোনটি খোলা পাননি। ফোনটি আর খোলাও হয়নি। রিয়াদের বাবা বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। সেদিন সন্ধ্যায় আবারও ফোন আসে। এবার আসে বরিশাল থেকে। তার সন্তানকে খুঁজে পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনায় আহত অবস্থায়। এরপর ফোন আসে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে। তারা প্রত্যেকেই বলছে-রিয়াদকে পাওয়া গেছে। বিকাশে টাকা পাঠালে রিয়াদকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। প্রত্যেকের বক্তব্যই অভিন্ন। রিয়াদের বাবার বুঝতে কষ্ট হয় না, প্রতারকরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে তার কাছে অনবরত ফোন দিচ্ছে। যদিও রিয়াদকে পাওয়া গেছে চারদিন পর। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে পড়ে ছিল। অর্ধমৃত অবস্থায়। সে আরেক ইতিহাস। ভুয়া পুলিশের দল তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। টাকা পয়সা রেখে দিয়ে চারদিনের মাথায় ফেলে রেখে যায়। 

অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে একটি চক্র এভাবেই নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কখনো পুলিশ অফিসার, কখনোবা চিকিৎসক, পথচারী এবং নিজেদের হৃদয়বান মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ফোন করে বিকাশ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। এই চক্রের কবলে পড়ে অনেকে নিঃস্ব হচ্ছেন। চক্রটি পত্রিকায় দেওয়া নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেখে যেমন নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা আদায় করছে, তেমনি আবার স্ত্রীর মোবাইল ফোনে স্বামীর বিপদের কথা বলে টাকা আদায় করছে। ভুক্তভোগী লোকজন এবং পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এই চক্রের অপতৎপরতার চিত্র পাওয়া গেছে।

আবার অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পেরে সেপথে এগোয় না। রাসেল নামে এক তরুণের সন্ধান চেয়ে খবর প্রকাশ হয় পত্রিকায়। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে রাসেল নিখোঁজ হয় বলেও খবরে বলা হয়। কেউ তার সন্ধান   পেলে যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল ফোন নম্বরও দেয়া হয়। এদিকে এই নিখোঁজ সংবাদকে পুঁজি করে রাসেলের পরিবারের সঙ্গে ভালুকা থেকে যোগাযোগ করা হয়। ওই ব্যক্তি নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে জানায়, ভালুকা এলাকায় রাসেল এক্সিডেন্ট করেছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। পরিবার যদি চান তবে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে পারেন। তার জরুরি চিকিৎসায় রক্ত ও ওষুধের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বিকাশের মাধ্যমে এই টাকা বিকাশে পাঠালে তিনি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে রাসেলকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ঢাকা থেকে পরিশোধ করলে হবে।

এদিকে স্বজন এক্সিডেন্ট করেছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এমন খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে রাসেলের পরিবার। তারা যে কোনো মূল্যে স্বজনকে ফিরে পেতে চায়। চিকিৎসার জন্য নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চান। তাই সাড়ে তিন হাজার টাকা নয় প্রয়োজনে আরো বেশি টাকা দিতেও প্রস্তুত। সূত্র জানায়, রাসেলের স্বজনরা বিকাশে টাকা না দিয়ে ভালুকায় পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে টাকা দেওয়ার জন্য মনস্থির করেন। ভালুকা থেকেই ওই ব্যক্তিকে ফোন করে জানতে চান তিনি কোথায় আছেন? তার সঙ্গে দেখা করে রাসেলের স্বজনের পক্ষ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা তার হাতে তুলে দেয়ার জন্য বলেন। কিন্তু তিনি বলেন, বিকাশে টাকা পাঠাতে হবে। সে দূরে আছে। হাতে হাতে নিতে পারবে না। এমন কথা শুনে সন্দেহ হয় রাসেলের পরিবারের। তারা স্থানীয় হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন রাসেল নামে কেউ নেই। ওই নাম্বারটিও বন্ধ।

পুলিশ বলছে, বিপদগ্রস্ত মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এভাবে প্রতারক চক্র টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নিজেদের সচেতনতা ও বুদ্ধির জোরে কেউ কউ পার পেলেও অনেকে এই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের অনেক অভিযোগ তাদের কাছে আছে।

সর্বশেষ খবর