মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

আইনি জটিলতায় পরিবেশ আদালতে মামলা হয় না

আরাফাত মুন্না

রাজধানীর আদালতপাড়ায় পুরনো জজ কোর্ট বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার ৩১ নম্বর কক্ষে অবস্থিত ঢাকা বিভাগীয় পরিবেশ আদালত। যুগ্ম জেলা জজ আশিকুল খবির এ আদালতের বিচারক। এ আদালতে ২ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন থাকলেও পরিবেশসংক্রান্ত মামলা মাত্র ১১৫টি। এ কারণে মাদকসহ অন্যান্য ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার বিচারও হয় এ আদালতে। দেশের একমাত্র পরিবেশ আপিল আদালতটি রয়েছে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের পঞ্চম তলায়। জেলা ও দায়রা জজ মশিউর রহমান চৌধুরী এ আদালতের বিচারক। এখানে পরিবেশসংক্রান্ত মাত্র পাঁচটি আপিল বিচারাধীন রয়েছে। এখানেও অন্যান্য মামলার বিচার চলে। আইনজ্ঞরা জানান, পরিবেশ আদালতে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে নানা আইনি জটিলতা রয়েছে। একজন ভুক্তভোগী এখানে সরাসরি মামলা করতে পারেন না। তারা বলেন, পরিবেশ অধিদফতর থেকে মামলা না করার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি। মামলা না থাকায় পরিবেশ আদালতেরই যেন পরিবেশ নেই। এ আদালতে জনগণের সরাসরি মামলা করার সুযোগ দিয়ে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা। জানা গেছে, পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া পরিবেশ আদালতে কোনো মামলা করা যায় না। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে অনুমোদনের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগকারীকে আবেদন করতে হয়। কর্তৃপক্ষ অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে সন্তুষ্ট হলে ৬০ দিনের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী মামলা করার অনুমোদন দেয়। আইনের এসব শর্ত পূরণ করে কোনো বিচারপ্রার্থী এখানে আসতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন না।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ আইন, ২০০০ অনুযায়ী দেশের প্রতিটি জেলায় পরিবেশ আদালত গঠনের বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে তিনটি পৃথক পরিবেশ আদালত কার্যকর রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১১৫, চট্টগ্রামে ২৩৯ ও সিলেটে ৬২টি মামলা বিচারাধীন আছে। এ ছাড়া পরিবেশসংক্রান্ত ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন রয়েছে ৩ হাজার ৩৯০টি। প্রতি জেলা শহরে পরিবেশ আদালত না থাকায় স্থানীয় জনগণ জেনেশুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন না বলে অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর। এদিকে আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর আইন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাশন মন্ত্রণালয়ে নতুন ২৬টি আদালত গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় বিচারকসহ ১২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ সৃজনের একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো বিধি অনুসরণ করে আদালত গঠনের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়নি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘মন্ত্রণালয় কাজ করছে। শিগগিরই জানতে পারবেন।’ জানতে চাইলে পরিবেশ আপিল আদালতের বিশেষ পিপি এ এস এম রেজাউল করিম হিরণ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনে সরাসরি পরিবেশ আদালতে মামলা করার বিধান নেই। কেউ মামলা করতে হলে পরিবেশ অধিদফতরে তাকে অভিযোগ দাখিল করতে হবে। এসব করণেই এ আদালতে মামলা কম হচ্ছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন পরিবেশ দূষণ হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হচ্ছে না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ অধিদফতর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালাচ্ছে। তবে রাঘব-বোয়ালরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে বেরিয়ে যাচ্ছে। দু-এক জন শিল্পমালিকের সাজা হলেই পরিবেশ দূষণ অনেকটা কমে যাবে।

এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোনো নাগরিক যদি পরিবেশসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হন তিনি মামলা করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে সেই মামলা করতে গিয়ে তাকে যদি পরিবেশ অধিদফতরে আবেদন করতে হয়, সেখানে অপেক্ষা করতে হয় তাহলে মানুষের আগ্রহ কমে যাবে। দুর্ভোগ সহ্য করেও প্রতিকার চাইবে না। এখানে নাগরিকের অধিকারটা কিন্তু আর আদায় হলো না। তিনি বলেন, আমার মনে হয় সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে এ আইনটা সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের বিচারক দিয়ে পরিবেশ আদালত কার্যকর করা যাবে না। এ আদালত ভারতের আদলে সাজিয়ে হাই কোর্টের সমমর্যাদা দিয়ে বিচারকাজ করতে হবে। তার মতে, এ আদালতে জনগণের সরাসরি মামলা করার সুযোগ থাকা উচিত। পরিবেশবিদদের মতে, যারা কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে পরিবেশ দূষণ করছেন, তাদের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

সর্বশেষ খবর