শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভাইজানে সর্বনাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

ভাইজানে সর্বনাশ

‘ভাইজান’! একটু বসতে দেবেন? সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের যাত্রী ছাউনিতে অপরিচিত এক লোকের অনুরোধে একটু সরে বসেন সাইফুল। তিনি চট্টগ্রামের বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পেপার পড়ছিলেন সময় কাটাতে। অপরিচিত সেই লোকটি তার পাশে বসেই প্রশ্ন রাখলেন, ভাইজান যাবেন কোথায়? এমন প্রশ্নে সাইফুল বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে যাব। ভাইয়ের বাসা। জামাল খাঁ কোয়ার্টার।’ এ কথা শুনেই অপরিচিত লোকটি এমন একটা ভাবভঙ্গি করলেন যেন, সেই জায়গাটি তার চেনাজানা বহুদিনের। সাইফুলও তার পরিচিত। লোকটি তাকে বললেন, তিনি একই এলাকার মানুষ। এরপর ছোট ছোট খোঁজখবর। ভীষণ ভাব জমে যায় তাদের মধ্যে। এরপর হালকা আপ্যায়ন। আর এতেই ঘটে বিপত্তি। সাইফুলের যখন জ্ঞান ফেরে, তিনি নিজেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে দেখতে পান। তার কাছে যে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোনসেট, ঘড়ি ছিল—তার কিছুই আর নেই।

এভাবেই রাজধানীজুড়ে একটি ‘ভাইজান চক্র’ প্রতারণা চালিয়ে আসছে দিনের পর দিন। সাইফুলের মতো সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে টাকা-পয়সা-সোনা-দানাসহ মূল্যবান মালামাল। কোনো টার্গেট ব্যক্তির পেছনে সাধারণত ভাই চক্রের তিন সদস্য কাজ করে। একজন খাতির জমায়, ওই ব্যক্তির মাধ্যমেই  কৌশলে কাছে আসে আরেকজন। আর তৃতীয়জন অধিকতর সতর্কতার জন্য দূর থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। কোনো কোনো চক্রে সদস্য সংখ্যা আরও বেশি থাকে। একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম কৌশলও তারা অবলম্বন করে। কখনো কখনো প্রতারণা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়েও। চোখের সামনেই ‘ভাইজান’র কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় সবকিছু। কিন্তু কিছুই বলার শক্তি থাকে না সব হারানো মানুষটির। সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতোই দেখতে থাকেন তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার কাণ্ড। এ অবস্থায় আশপাশের মানুষেরও বোঝার উপায় থাকে না। তারা ভাবেন- মানুষগুলো তার পরিচিত। স্বেচ্ছায়-ই হস্তান্তর করছেন কাছের টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র।

সমপ্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এই চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর সদস্যরা। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মো. আলমগীর মিয়া (২৮) চক্রের সক্রিয় সদস্য। তবে পলাতক রয়েছে চক্রের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পিবিআই। গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে ভয়ংকর সব তথ্য দেন আলমগীর। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতেও সেসব কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাদের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। প্রত্যেক গ্রুপের এলাকাও নির্দিষ্ট রয়েছে। রেল স্টেশনে তারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। এর বাইরে বিমানবন্দর, আবদুল্লাহপুর, কুড়িল বিশ্বরোড, মহাখালী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী বাস টার্মিনালসহ জনবহুল এলাকায়। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, লাকসাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,  ভৈরবসহ একাধিক শহরে তারা এই প্রতারণা করে আসছে। সূত্র জানায়, পিরোজপুরের বাসিন্দা ঢাকার একটি সেলুনে কর্মরত হাসান (২০) এ ব্যাপারে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন— তার ওমান প্রবাসী ফুফা সিফাত গত ২০ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মালামাল পাঠিয়েছিলেন। ওইদিনই তিনি মালামালগুলো আনতে যান। ওই সময় তার কাছে ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং অফিসের কাজে ব্যবহূত ল্যাপটপ, ৫টি মোবাইল, ৮টি পেন ড্রাইভ ছিল। ফ্লাইট আসতে দেরি হওয়ায় ১১টার দিকে তিনি বিমানবন্দর সংলগ্ন প্রধান সড়কের ফুটপাথে চা খাচ্ছিলেন। ওই সময় কবির নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরই মধ্যে সেখানে আলমগীর নামে আরেকজন হাজির হয়। কবির তাকে শ্যালক বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। আলমগীর তার ফেসবুক আইডিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। তারাও শাহজালাল থেকে মালামাল গ্রহণ করতে এসেছে বলে জানায়। তার বাড়ি পিরোজপুর জানালে তারা জানায় তাদের বাড়ি ঝালকাঠি। এভাবে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। বিমানবন্দর এলাকায় ঘুরাঘুরির একপর্যায়ে তারা গাড়ি পার্কিংয়ের ২য় তলায় যায়। এ সময় আলমগীর দুটি জুস এনে তার সামনেই কর্ক খুলে। সে নিজেই একটা খায়। অপর একটি জুস কবিরকে খেতে দেয়। কবির কিছুটা জুস খেয়ে হাসানকে দেয়। ওই জুস খাওয়ার পরই হাসানের মাথা চক্কর দেয়। ট্রলিতে বসেন তিনি। হাত-পায়ের শক্তি হারিয়ে যায়। কাউকে কিছু বলারও সামর্থ্য ছিল না তার। তিনি দেখছিলেন, কবির এবং আলমগীর তার পকেটে থাকা ১০ হাজার টাকাসহ মানিব্যাগ, একটি স্যামসাং জে-৭ মোবাইল ফোনসেট, ব্যাগে থাকা ২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ও একটি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনসেট, ৮টি পেন ড্রাইভ ও একটি ক্যানন ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে নিচ্ছে। যার সর্বমোট মূল্য অনুমান ৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। তিনি তখন অর্ধচেতন, তন্দ্রাচ্ছন্ন। এ অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে ২য় তলার সিঁড়ির কাছে এলে এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে পুলিশ বক্সে যান।

এ ঘটনায় হাসান বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি বিমানবন্দর থানা থেকে পিবিআইয়ে হস্তান্তর হয়। তদন্ত করেন সংস্থাটির এসআই মো. জুয়েল মিঞা। তদন্তে অজ্ঞান পার্টির বিশালচক্রের সন্ধান মেলে। পরে ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদের দিকনির্দেশনায় অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. বশির আহমেদের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আলমগীর মিয়াকে (২৮) গ্রেফতার করে। এ সময় তার কাছ থেকে চোরাইকৃত ৩৫ হাজার টাকা, একটি মোবাইল সেট, একটি পেন ড্রাইভ এবং তার ব্যবহূত ১টি মোবাইল উদ্ধার করে। আটককৃত আসামি জিজ্ঞাসাবাদে ভয়ংকর তথ্য দেন। তিনি জানান, তার এই চক্রের মূল হোতা তাজুল ওরফে কবির ওরফে আলু। এ ছাড়া এই গ্রুপে আছে জাহিদ, ইংলিশ মাসুদ। এর মধ্যে ডিগ্রি পাস মাসুদ ১৪ বছর ধরে এই কাজ করে। আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে রবিউল। মাসুদ ছাড়াও তার গ্রুপে জনিসহ আরও অনেকেই কাজ করে। পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আলমগীর জানান, তাজুল ইসলাম ওরফে কবিরের নেতৃত্বে জাহিদ ও সে বয়ান (আলাপচারিতায়) দিয়ে সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে ভাই সম্পর্ক গড়ে তুলে। এরপর তার কাছে কী পরিমাণ টাকা আছে জানার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাদের চক্রের আরেক সদস্যকে কাছে ডেকে আত্মীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাকি সদস্যরা সাধারণ মানুষ হিসেবে নিকটবর্তী দূরত্বে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। কখনো কখনো নিজেদের টার্গেট ‘ভাইজান’র অঞ্চলের লোক বলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সখ্য গড়ে তোলে। এরই মধ্যে তাদের একজন উঠে গিয়ে জুস/কোল্ড ড্রিংস/ঝালমুড়ি/চানাচুর/চা/কফি নিয়ে আসে। টার্গেটের সামনেই একজন কোল্ড ড্রিংসের কর্ক খুলে খেতে থাকে যাতে সন্দেহ না হয়। অপরজন কথা বলার ফাঁকেই অগোচরে আঙ্গুলের ফাঁকে রাখা বিশেষ ওষুধ ডিসুপান-২ এর গুঁড়া করা মিশিয়ে দেয়। একজন খেয়ে দেওয়ায় ভিকটিমের কোনো সন্দেহ থাকে না। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ভিকটিম তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বসে পড়ে। তার সামনেই কাছে থাকা সর্বস্ব লুটে নেয়। ভিকটিম দেখলেও দেখা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর