রবিবার, ১ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেড় বছরের প্রস্তুতিতে হামলা

চার্জশিট চূড়ান্ত, আসামি হচ্ছেন ৮ জন

সাখাওয়াত কাওসার

টানা দেড় বছরের প্রস্তুতি নিয়ে গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালায় জঙ্গিরা। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তামিম আহমেদ চৌধুরী দেশে এসে পুরনো জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষ নেতা এবং সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় নব্য জেএমবি নামের নতুন প্লাটফরম। ২০১৫ সালের শুরু থেকেই বড় হামলা টার্গেট করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলতে থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিবিড় প্রশিক্ষণ। দফায় দফায় ঢাকার কয়েকটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট রেকির পর তামিম এবং নূরুল ইসলাম মারজানের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের লেকপাড়ের অভিজাত হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে নারকীয় হামলা চালায় জঙ্গিরা। দীর্ঘ দুই বছর তদন্ত শেষে এই হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২১ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি। কমান্ডো অভিযানে নিহত পাঁচ হামলাকারী ছাড়াও আরও আটজন মারা গেছে সিটিটিসি ও র‌্যাবের অন্যান্য অপারেশনে। গ্রেফতার হওয়া ছয় আসামি ইতিমধ্যে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। দুজনকে পলাতক দেখিয়ে প্রস্তুত হওয়া চার্জশিট আদালতে জমা হবে খুব শিগগিরই।

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে ৯ ইতালিয়ান, সাত জাপানিজ, একজন ভারতীয়, একজন আমেরিকান-বাংলাদেশ দ্বৈত নাগরিক ও দুজন বাংলাদেশি এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিরা রেস্টুেরেন্টের অন্যান্য অতিথি এবং কর্মচারীদের রাতভর জিম্মি করে রাখে। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে শেষ হয় এই জিম্মিদশা। অপারেশন থান্ডারবোল্ট নামে পরিচালিত এই অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও একজন পিত্জা শেফ নিহত হয়। আলোচিত এই ঘটনায় গুলশান থানার পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদেশিরা জমায়েত হন রাজধানীর এমন আরও ৪টি রেস্টুরেন্ট রেকি করলেও মূলত তামিম এবং মারজানই হোলি আর্টিজানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেন। বর্বরোচিত ওই হামলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ২১ জন জঙ্গির জড়িত থাকার তথ্য ও প্রমাণ তারা পেয়েছেন। তাদের নামেই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে যারা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার বিবরণ উল্লেখ করে চার্জশিটে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া ছয় জঙ্গির মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব, হাদিসুর রহমান সাগর, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ ও রাকিবুল হাসান রিগ্যানের নাম থাকছে চার্জশিটে। সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, হামলায় মোট ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন সময়ে অভিযানে নিহত হয়েছে। বাকি আটজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে। এদের মধ্যে শরীফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ নামে দুজন পলাতক রয়েছে। গ্রেফতারকৃত ৬ জনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধেই চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তুরস্ক হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তামিম। শুরুর দিকে জুনুদ আল তাওহিদ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করার চেষ্টা করে তামিম। পরবর্তীতে পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা আবদুস সামাদ মামু, মামুনুর রশীদ রিপন ও সরোয়ার জাহানসহ নব্য জেএমবি নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গঠন করে। তামিমের ঘনিষ্ঠ ছিল রিপন এবং রাশেদ। এরাই সিরিয়া ক্লাস্টারের নিবরাস, র‌্যাশ, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামসহ বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। হোলি আর্টিজানে হামলার দিন সে মিরপুরের একটি আস্তানায় বসে দুই সহযোগীসহ হামলার পুরো বিষয়টি অনলাইনের মাধ্যমে দেখভাল করে। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশ সদর দফতর ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে দুই সহযোগীসহ মারা যায় তামিম। হামলার আরেক শীর্ষ পরিকল্পনাকারী হিসেবে উঠে এসেছে সারোয়ার জাহান ওরফে আবদুর রহমানের নাম। সারোয়ার জাহান একসময় পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা ছিল। তামিমের মাধ্যমে সে নব্য জেএমবিতে যোগদান করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার দলদলি ইউনিয়নের নামো-মুশরীভূজা গ্রামের আবদুল মান্নানের সন্তান সারোয়ার। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় সারোয়ারের বাড়িতে র‌্যাব অভিযান চালালে পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাতে গিয়ে নিহত হয় সে। এ ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ, নূরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকোলেট, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, রায়হান কবির ওরফে তারেক, হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া নিহত জঙ্গিরা হলো— রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ।

সর্বশেষ খবর