রবিবার, ১ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার দুই বছর

বিভীষিকাময় সেই ১২ ঘণ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিভীষিকাময় সেই ১২ ঘণ্টা

নতুন রূপে হলি আর্টিজান। গতকাল তোলা ছবি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান। পবিত্র রমজানের রোজা তখন শেষ হয়ে আসছে। চারদিকে ঈদের আমেজ। মানুষের দম ফেলার ফুরসত নেই। রাজধানী ঢাকার সড়কগুলোতে গাড়ির ভিড়। ভালোভাবেই রোজার মাস কাটায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কিছুটা শৈথিল্য ভাব। গুলশাল-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের পূর্ব দিকের শেষ মাথার ৫ নম্বর বাড়িটিতে ছিল হলি আর্টিজান বেকারি নামে একটি অভিজাত রেস্তোরাঁ। ভিতরে অতিথিদের আড্ডা। বেশির ভাগই বিদেশি। তাদের পদচারণে মুখরিত। হালকা মিউজিকে ভিন্ন আমেজ। এর মধ্যেই রাত সাড়ে ৮টার পর ঠা ঠা শব্দে কেঁপে ওঠে চারদিক। একবার নয়, বার বার। গুলির বিকট শব্দ। আতঙ্ক চারদিকে। মানুষের ছোটাছুটি। রেস্তোরাঁর ভিতর অস্ত্রধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে বিভীষিকাময় পরিবেশ। অজানা আতঙ্ক। খবর পেয়ে পুলিশ যায়। রেস্তোরাঁ দখলে নেওয়া অস্ত্রধারীরা গ্রেনেড ছুড়ে মারে। বাইরে লাশ পড়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তার। আহত হয়ে কাতরাতে থাকেন পুলিশসহ অসংখ্য মানুষ। আর রেস্তোরাঁর ভিতর ততক্ষণে রক্তের স্রোত। বিভীষিকাময় সেই পয়লা জুলাইয়ের রাতের ঘটনাটি পাল্টে দেয় বাংলাদেশের চিত্র। জঙ্গি হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নিহত হওয়া, দেশের তরুণদের কারও কারও এই অপরাধে জড়িত থাকা, আতঙ্ক, অবিশ্বাস, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, বিষাদ— সব মিলিয়ে দম বন্ধ হওয়া এক পরিস্থিতি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবই যেন থমকে গিয়েছিল সেই রাতে। সে রাতের ঘটনা মনে করলে এখনো আঁতকে ওঠে মানুষ। গুলশানের বাসিন্দাদের বুক কাঁপে এখনো। হামলাকারীদের গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়েন তারা এখনো। হলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলার পর বেঁচে আসা ভাগ্যবান ২৫ জনের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছিল কতটা বীভৎস ছিল সেই রাত। গা শিউরে ওঠা কাহিনীকেও রীতিমতো হার মানায় সেই রাত। নিজেদের জীবনের মায়ায় বেঁচে আসা ব্যক্তিরা জঙ্গিদের প্রতিটি নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। লাশের রক্তে ভেজা ফ্লোর এবং লাশ পাশে নিয়ে তারা কাটিয়েছিলেন সারা রাত। রাত পৌনে ৯টার দিকে হলি আর্টিজান বেকারিতে কয়েকজন যুবক অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় তারা গুলিও ছোড়ে। তখন সেখানে পুলিশ গেলে তাদের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। শুরুতেই গুলিতে প্রদীপ ও আলমগীর নামের পুলিশের দুজন কনস্টেবল ও আবদুর রাজ্জাক নামের এক পথচারী আহত হন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। তাত্ক্ষণিকভাবে পুলিশ ওই এলাকা ঘেরাও করে ফেলে। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে ভিতর থেকে অস্ত্রধারীরা পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র?্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিনসহ আহত কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী উল্লেখ করে দিবাগত রাত দেড়টায় পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এ তথ্য জানায়। এর আগে রাত সাড়ে ১১টার দিকে জঙ্গিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা চালানো হয়। ঘটনাস্থলে আসেন র?্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি রাতেই সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযানে অংশ নেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্মিলিতভাবে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়।

 নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলের পাশ থেকে গণমাধ্যমকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে দেওয়া হয়। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় রাতেই ২০ জনকে হত্যা করা হয়। নিহত ২০ জনের মধ্যে ৯ জন ইতালির, সাতজন জাপানের ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি। ২ জুলাই সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এয়ার কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অভিযানের মাধ্যমে একজন জাপানি, দুজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। পাঁচজন হামলাকারীসহ ছয়জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ১২ ঘণ্টার এই জিম্মি ঘটনায় ২০ জিম্মি, ছয় সন্ত্রাসী, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৮ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২০ জন পুলিশ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর