রবিবার, ১ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে ওরা

মির্জা মেহেদী তমাল

বদলে যাচ্ছে ওরা

হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের একজন নিবরাস ইসলাম। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েছেন। ফুটবল ছিল ধ্যানজ্ঞান। কোথায় ফুটবল খেলেননি তিনি? পুরান ঢাকায় দাদাবাড়ির অলিগলি, উত্তরার মাঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস; এমনকি জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর ঝিনাইদহে যখন আত্মগোপন করেছিলেন, তখনো ফুটবল ছিল তার সঙ্গী। ‘এ লেভেল’ শেষে ২০১২ সালে নিবরাস মালয়েশিয়ার মোনাসে পড়তে গিয়েছিলেন। থাকতেন ডরমিটরিতে (ছাত্রাবাস)। নিবরাসের বাবা মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন ছেলেকে দেখতে। কিছু পরিবর্তন দেখেছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারেননি কিছু। তিনি দেখেছেন, ছেলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিউনিশিয়ার নাগরিক। নিবরাস সেখানে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে নির্দিষ্ট একটি মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও আর আগের মতো আগ্রহ নেই। হাতে সব সময় রিস্টব্যান্ড পরতেন নিবরাস, সেটাও ছিল না। বছর দুয়েক পর নিবরাস দেশে ফিরে আসেন। তবে তিউনিশিয়ার সেই বন্ধুর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। নিবরাসের মতোই বদলে গিয়েছিল ওরা। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী আরও চার তরুণ। দুজন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েছেন। পুরোদস্তুর ঢাকার বিত্তবান পরিবারের সন্তান। অন্য দুজন বগুড়ার দরিদ্র পরিবারের মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলে। দিন শেষে এই পাঁচজনের পরিচয়, তারা জঙ্গি। কুপিয়ে ও গুলি করে মানুষ হত্যা করেছেন তারা। হোলি আর্টিজানে হামলার পর ওই তরুণদের একঘরে হয়ে যাওয়া স্বজনদের কেউ কেউ বলছেন, ‘তাদের অজান্তে ছেলেরা বদলে গিয়েছিল। বুঝতেই পারিনি’। ইংলিশ মিডিয়ামের এ লেভেলের ছাত্র আহমেদ আসওয়াদ ইমতিয়াজ ওরফে অমি। ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ নিখোঁজ। গুলশানের বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর তার খোঁজ মিলছে না। কোথাও নেই। গুলশান থানায় এ ব্যাপারে একটি জিডি হয়। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক এক বছরের মাথায় এই অমিকে পাওয়া যায় ভয়ঙ্কর এক মানুষরূপে। গত বছর মার্চে কুমিল্লায় বাসে পুলিশ তল্লাশি চালালে বাস থেকে দুই তরুণ নেমে যায়। তাদের একজনের হাতে থাকা গ্রেনেড ছুড়ে মারে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। গ্রেনেড হামলাকারী গুলিবিদ্ধ হয়। আর এই গ্রেনেড হামলাকারী আর কেউ নন, তিনি হলেন অমি। অমিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় অংশ নেওয়া রোহান ইমতিয়াজের বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুল বলেন, ‘আমার স্ত্রী শিক্ষক। আমি নিজেও শিক্ষক ছিলাম। আমরা মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু আমার ছেলে কখন ভুল পথে চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি। এটা আমার জন্য চরম ব্যর্থতা। বাবা হিসেবে যেগুলো আমার খেয়াল করার কথা ছিল, সেগুলো খেয়াল করতে পারিনি।’ ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি সেমিনারে গুলশান হামলায় নিহত নিবরাস ইসলামের বাবা নজরুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলেটার বিষয়ে যদি আগে বুঝতাম, আমি তাকে সারাজীবন সঙ্গে সঙ্গে রাখতাম।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যেন আর কোনো বাবা-মায়ের বুক খালি না হয়। আর কোনো বাবা-মাকে যেন এমন হাহাকার করতে না হয়। আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অবশ্যই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারব। আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ কারও নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব্ব দিয়ে তা খোঁজ করার আহ্বান জানান নিবরাসের মা। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের নিখোঁজ হওয়ার পর গুরুত্ব দিয়ে খোঁজ করা হলে আমরা হয়তো গুলশানের ঘটনা এড়াতে পারতাম।’ বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের কাছে তরুণ যোদ্ধা পাঠানোর অভিযোগ ছিল যার বিরুদ্ধে সেই আমিনুল ইসলাম বেগও তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সহায়তা করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বেশ কয়েক মাস থাকার পর জামিনে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবার ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা এমন যে, পরিবারের বন্ধন কম। তরুণরা কাছে পায় বন্ধুদের। তরুণরা প্রথম জঙ্গিবাদের দাওয়াত পায় বন্ধুদের কাছ থেকেই।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর