শুক্রবার, ২৭ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিভৃত পল্লীতে নভোথিয়েটার

শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর

নিভৃত পল্লীতে নভোথিয়েটার

প্রায় সাড়ে ১৩০০ কোটি বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল। বিজ্ঞানের এই গূঢ় তথ্য রংপুর সদর উপজেলার নিভৃত পল্লী গঞ্জিপুরের মানুষের জানার কথা নয়। কিন্তু গ্রামের অনেকেই এখন এটা জানেন। কারণ মহাবিশ্বের জন্ম ইতিহাস প্রতিদিন ১৫ বার করে প্রদর্শিত হয় গঞ্জিপুরে। এই গ্রামে ছোট আকারের একটি প্ল্যানেটোরিয়াম বা নভোথিয়েটারে মাত্র ৩০ টাকায় টিকিট কেটে এলাকার লোকজন দেখছে গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথের জীবনবৃত্তান্ত আর জেনে নিচ্ছে নক্ষত্ররাজির নাম-পরিচয়। ২০০১ সালে চালু হওয়া দেশের প্রথম নভোথিয়েটার এটি। ঢাকার তেজগাঁওয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তৈরি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার’ চালু হয় এরও তিন বছর পর ২০০৪ সালে। ১৪ জুলাই দুপুরে নভোথিয়েটারের সামনে দেখা হয় গঙ্গাচড়া উপজেলার মহীপুর এলাকার স্কুলশিক্ষক খয়রাত হোসেনের সঙ্গে। কিছুক্ষণ আগে তিনি তার কলেজপড়ুয়া মেয়ে লাবণী আক্তারকে নিয়ে নভোথিয়েটার প্রদর্শনী কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। খয়রাত হোসেন বললেন, এতদিন তিনি আকাশে চাঁদ আর তারা দেখেছেন। কিন্তু সেগুলোর অনেক কিছুই তার কাছে ছিল রহস্যে ভরা। এখন অনেক রহস্যই তার কাছে আর রহস্য নেই। বিশেষ করে কীভাবে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ হয়, তা তিনি জেনে গেছেন।

মেয়ে লাবণী বলে, ‘বাড়ির কাছে নভোথিয়েটার দেখে মহাকাশ-সৌরজগৎ সম্পর্কে অনেক কিছুই শিখলাম। বইয়ে পড়লে সবকিছু মনে থাকে না। কিন্তু যা দেখলাম, তা অন্তরে গেঁথে গেছে। আজীবন হারাবে না।’

যেভাবে এলো এই নভোথিয়েটার : গঞ্জিপুর রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। এ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক মিয়া বলেন, নভোথিয়েটার যেখানে স্থাপন করা হয়েছে, সেখানটায় একসময় ছিল নিধুয়া পাথার। ধু ধু বালুচরের কারণে এসব জমিতে আবাদ তেমন হতো না। কিন্তু কীভাবে এই নিধুয়া পাথারে গড়ে উঠল বিজ্ঞানের অপার রহস্যজগতের প্রবেশদ্বার? নোয়াখালীর দুর্গাপুরের সিএসপি কর্মকর্তা এ এস এম শাহ্ আলম চৌধুরী ১৯৯৭ সালে আমেরিকা বেড়াতে গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার বিনোদনকেন্দ্র ‘ডিজনিল্যান্ড’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। দেশে ফিরে তিনি ওই আদলে একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ার কাজে নেমে পড়েন। তার লক্ষ্য ছিল, শহর থেকে দূরে নিভৃত পল্লীতে তিনি বিনোদনকেন্দ্র গড়বেন। অবশেষে গঞ্জিপুরেই তিনি এই বিনোদনকেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। ২০০০ সালে ১০০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে ‘ভিন্নজগৎ’ নামে একটি বিনোদনকেন্দ্র। একে একে নানা রকম বিনোদন উপকরণ সেখানে যুক্ত হতে থাকে। একসময় এখানে একটি নভোথিয়েটার স্থাপনের পরিকল্পনা মাথায় আসে। কিন্তু দেশে এ জিনিস তো কোথাও নেই। শুরু হয় খোঁজখবর। ভারতের বিরলা প্ল্যানেটোরিয়াম হয়ে ওঠে আদর্শ। বেশকিছু যন্ত্রাংশ ভারত থেকে এনে দেশীয় প্রকৌশলীদের দিয়ে তৈরি করা হয় ছোট আকারের নভোথিয়েটার। এর নকশা করেন রংপুরের চারুকলার শিক্ষক জিয়া কবির।

প্ল্যানেটোরিয়ামের ডিম্বাকৃতি ডোম : নভোথিয়েটারের মূল প্রদর্শনী কক্ষটি ডিম্বাকৃতি। এর উচ্চতা ৬০ ফুট এবং ব্যাসার্ধ ৬০ ফুট। কোনো পিলার ছাড়াই এটি বিশেষ কায়দায় তৈরি করা হয়েছে। ডোমের ভিতরের দেয়ালে মোটা কালো কাপড় সেঁটে দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রক্ষেপকের আলো প্রতিফলিত না হয়। একসঙ্গে আড়াই শ লোকের বসার জায়গা আছে এতে। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি প্রদর্শনী হয়। প্রতিবার দর্শকেরা বসলে প্রদর্শনী কক্ষ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে ওঠে। আর কক্ষের গম্বুজাকৃতি ছাদে ফুটে ওঠে রাতের আকাশের নক্ষত্ররাজি। এতে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন দর্শকেরা। মনে হয়, যেন অমাবস্যার রাতে খোলা আকাশের নিচে তারা বসে আছে। এরপর একে একে যখন মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য উন্মোচিত হয়, দেখানো হয় কৃষ্ণগহ্বরের অমোঘ টান, তখন এক অচেনা জগতের দুয়ার খুলে যায় তাদের সামনে। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় নভোথিয়োটারের সামনে। তাদের একজন শিউলী শারমিন শান্তা বলেন, ‘নভোথিয়েটারের ভিতরে ঢুকে মনে হয়েছে, আমরা যেন মহাকাশে অবস্থান করছি। তারকাগুলো যখন একসঙ্গে জ্বলজ্বল করে ওঠে, তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য ও মহাকাশ সম্পর্কে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি এই নভোথিয়েটার থেকে।’

২০০১ সালের ৭ জানুয়ারি এই নভোথিয়েটার চালুর কিছুদিন পরই এটির প্রতিষ্ঠাতা এ এস এম শাহ আলম চৌধুরী মারা যান। নভোথিয়েটারটি এখন দেখভাল করছেন তার ছোট ভাই এস এম কামাল। তিনি বলেন, ‘শহরের মানুষের অনেক কিছু জানার ও শেখার সুযোগ রয়েছে। গ্রামের মানুষ এখনো তুলনামূলকভাবে অনেক পিছিয়ে। এসব মাথায় রেখে দেশে প্রথম নভোথিয়েটার নিভৃত পল্লীতেই স্থাপন করা হয়। এখানে নামমাত্র প্রদর্শনী ফি রাখা হয়। যা আয় হয় তা দিয়ে এটি পরিচালনার খরচ উঠে আসে না। তবু চালাই ভাইয়ের স্বপ্ন ধরে রাখতে। ভবিষ্যতে এটাকে আরও আধুনিক করার চিন্তা রয়েছে।’ এই নভোথিয়েটার তৈরিতে খরচ হয়েছে দেড় কোটি টাকা। বিপরীতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণের পেছনে ১২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ভিন্নজগতের সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক (এজিএম) রিফায়েত ইসলাম বলেন, বিনোদনকেন্দ্রে নানা রকম উপকরণ থাকলেও দর্শনার্থীদের প্রধান আকর্ষণের বিষয়ে পরিণত হয়েছে নভোথিয়েটার। এটিই বিনোদনকেন্দ্রটির সুনাম এনে দিয়েছে। নভোথিয়েটারের অপারেটর হিসেবে নিয়োজিত আছেন রংপুর সদরের পানবাজার গ্রামের বাদশা মিয়া (৪৫)। আর্থিক টানাপড়েনের কারণে তিনি পড়ালেখা করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘প্রথমে কিছুই বুঝতাম না। পরে শিখে নিয়েছি। নিজে লেখাপড়া শিখতে পারিনি। কিন্তু নভোথিয়েটার চালাতে পারি। এটি দেখতে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন আসেন। তারা সৌরজগৎ দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। এটাই আমার সার্থকতা।’

সর্বশেষ খবর