শুক্রবার, ২৭ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

টার্গেট দরিদ্র পরিবার

মির্জা মেহেদী তমাল

টার্গেট দরিদ্র পরিবার

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে বাসা। গাজীপুরে আছে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। অঢেল সম্পদের মালিক তিনি। করেন সরকারি চাকরি। ল্যান্ড অফিসে। নাম তার শিউলি বেগম। নরসিংদীর বাসিন্দা রফিক নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। রফিককে ভালো একটি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন শিউলি। কিছুদিন যাওয়ার পর শিউলি তাকে বলেন তিনি তাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান রফিক ভালোবাসার কথা শুনে অবাক হন। বলেন কী! এত বড়লোক মহিলা, তিনি কিনা তাকে ভালোবাসেন? নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে। কিন্তু শিউলির কথাবার্তা তার আচরণে রফিকের মনেও ভালোবাসার জন্ম হয়। বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি, ঘনিষ্ঠতা হয় তাদের। এর পরও রফিক পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। হয়তো একদিন তাকে ছেড়েছুড়ে চলে যাবেন শিউলি। এজন্য মনে তার ভয় ছিল। একদিন শিউলি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ভাবেন রফিক, শিউলি আসলেই তাকে ভালোবাসেন। নইলে বিয়ে করতে চাইতেন না। বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হন রফিক। রফিক নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা। তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই এখন সুখের মুখ দেখবেন। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির পুরো দায়িত্ব থাকবে তার ওপর। তিনিও হবেন মালিক। তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর মনোহরদী উপজেলার চরমান্দালিয়া কাজী অফিসে বিয়ে করেন তারা। রফিক থাকেন নিজের বাড়িতে। শিউলি গুলশানে। শিউলি তাকে জানান, কিছুদিন পর তারা একসঙ্গে থাকবেন।শিউলি তার বরের বাড়িতে গিয়ে দোচালা টিনের ঘর ভেঙে নতুন ঘর, বাউন্ডারি দেয়াল ও বড় গেট নির্মাণ করে দেন। এ বাড়িতে শিউলি থাকলে সকালেই অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে যান। সন্ধ্যায় ফেরেন। স্বামীর এলাকার মসজিদ নির্মাণে নগদ ১ লাখ টাকা ও সেখানকার একটি স্কুলে ১২টি সিলিং ফ্যান প্রদান করেন। স্থানীয় মানুষের মন জয় করে নেন শিউলি। গ্রামের সবাই শিউলি বেগমকে ভালোভাবে গ্রহণ করেন। লোকজন তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। কিছুদিন পর শিউলি বেগম তার স্বামীকে জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার এসিল্যান্ড হিসেবে বদলি হয়েছেন তিনি। এ খবরও গ্রামের সবাই জানতে পেরে খুশি। রফিকের স্ত্রী এসিল্যান্ড! এটা যেন তাদের গর্বের বিষয়। শিউলি বেগম কটিয়াদী উপজেলা সদরে ভোগপাড়া খাদ্য গুদামের সঙ্গে চার তলা ভবনে বাসা ভাড়া নেন। সেখানেই রফিককে নিয়ে থাকতে শুরু করেন। শিউলি প্রাইভেট কারে করে প্রতিদিন অফিসে চলে যান। সন্ধ্যায় আসেন। এভাবে চলছিল তাদের জীবন। একদিন শিউলি বেগম তার স্বামী রফিককে বলেন, বাংলাদেশের জজ কোর্টসমূহে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে লোক নিয়োগ করা হবে। তিনি সেই নিয়োগ কমিটির একজন অন্যতম সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। রফিকের মাধ্যমে এ কথাটি তাদের এলাকায় চাউর হয়ে যায়। এর পরই এলাকার লোকজন দলে দলে রফিকের বাসায় ভিড় করতে থাকেন চাকরির জন্যে। কিন্তু টাকা ছাড়া চাকরি হবে না— এটা এলাকার লোকজন জানতেন। রফিকের স্ত্রী শিউলি বেগমের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হলে, টাকাটা বিপথে যাবে না। এমন চিন্তা করে কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া ও মনোহরদী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের লোকজন টাকা দিতে থাকেন শিউলি বেগমের কাছে। শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে অর্ধ কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেন শিউলি বেগম। শিউলি বেগম এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে কোনোরকম ইন্টারভিউ ছাড়াই চাকরির নিয়োগপত্র দিয়ে দেন। এর মধ্যে একজন নিয়োগপত্র নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দেখান। তারা পরীক্ষা করে দেখেন নিয়োগপত্রটি জাল। এ সংবাদটি দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি শিউলি বেগমও জানতে পারেন। একদিন সকালে শিউলি বেগম তার স্বামী রফিককে বলেন, যশোরের একটি পৌরসভার মেয়র লিটন ও ঢাকা বারের একজন কর্মকর্তা কটিয়াদীতে তার বাসায় বেড়াতে আসছেন, তাদের রিসিভ করে আনার জন্য রফিককে নরসিংদী পাঠান। কিন্তু সেখানে কাউকে না পেয়ে রফিক ফিরে আসেন বাসায়। এসে দেখেন শিউলি বেগম নেই। বাসার ভিতরে রাখা মূল্যবান সামগ্রী আর আলমারিতে থাকা বিপুল অঙ্কের টাকা আর স্বর্ণালঙ্কারও নেই। রফিক তার স্ত্রীকে ফোন করেন। কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ। স্থানীয় বেশ কয়েকজন তাকে জানান, তার স্ত্রী গাড়িতে করে দ্রুত চলে গেছেন বলে তারা দেখেছেন। এ ঘটনা এলাকায় জানাজানি হলে চাকরিপ্রত্যাশী লোকজন শিউলি বেগমের স্বামী রফিককে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। রফিকুল ইসলাম লোকজনকে বলেন, ‘আমি তার প্রতারণার শিকার হয়েছি। আমাকে বিভিন্ন ওষুধ খাইয়ে ও তাবিজ-কবচ দিয়ে অস্বাভাবিক করে রেখেছিলেন। লোকজনের টাকাপয়সা প্রদানের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ পরে শিউলি বেগমের বিরুদ্ধে রফিক কটিয়াদী মডেল থানায় মামলা করেন।

পুলিশ জানায়, রফিক শিউলি বেগমকে বিশ্বাস এমনভাবেই করেছিলেন যে, গুলশানে কোথায় তার বাসা তাও জানেন না। তা ছাড়া তদন্ত করে জানা গেছে, শিউলি বেগম সরকারি চাকরি করতেন না। অফিসে যাওয়ার নাম করে বাসা থেকে বেরিয়ে কোথায় যেতেন তাও জানতে পারেননি তার স্বামী রফিক। খুব দ্রুত সব ঘটনা ঘটে যাওয়ায় কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। মূলত শিউলি বেগম একজন প্রতারক। বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ির এলাকার লোকজনের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। এ ধরনের আরও কয়েকটি অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে পুলিশ জানায়। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, শিউলি বেগমের মতো বহু নারী দেশে সক্রিয়। তাদের টার্গেট দরিদ্র পরিবার। দরিদ্র পরিবারের সন্তানকে বিয়ে করার পর তাদের পরের টার্গেট থাকে শ্বশুরবাড়ির এলাকার লোকজন। এলাকার লোকজনের মন জয় করতে তারা স্থানীয় মসজিদে, স্কুলে সাহায্য করেন। পরে সুযোগ বুঝে এলাকার মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অজানার উদ্দেশে চম্পট দেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর