বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

সড়কে কেন বেপরোয়া প্রতিযোগিতা

চাঁদাবাজির মহোৎসব, অতিরিক্ত আয়ের টার্গেট চালকদের

সাঈদুর রহমান রিমন

সড়কে কেন বেপরোয়া প্রতিযোগিতা

যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাস রাস্তায় নামলেই দৈনিক চাঁদা, বখরা, বেতন-ভাতা মিলিয়ে অন্তত ছয় হাজার টাকা পরিশোধ করা চালকদের জন্য বাধ্যতামূলক নিয়ম। এর মধ্যে রয়েছে মালিক সমিতির নামে দৈনিক ১১০০ টাকা, মোবাইল কোর্ট বন্ধের নামে ৫০০ টাকা, শ্রমিকদের নানা সংগঠনের নামে ৫০০ টাকা এবং চালক, কন্ডাক্টর, হেলপারের বেতন-ভাতাসহ রুট খরচ, পার্কিং বখরা, টার্মিনাল খরচ, মস্তান ভাতা। এ ছাড়াও পুলিশ বখরা রয়েছে।

গাড়ির মালিক প্রতিদিন ৩-৪ হাজার টাকার বিনিময়ে গাড়ি দেন ড্রাইভারকে। সেই ড্রাইভার ভোর ৫টা-রাত ১২টা পর্যন্ত গাড়ি চালান নিজে অথবা হেলপারকে দিয়ে। গাড়ি থেকে যা আয় হয় তা ড্রাইভার পান। অতিরিক্ত আয়ের জন্যই ড্রাইভার অনেক বেশি সময় কাজ করেন।

ওয়াকিফহালরা জানান, বখরাবাজির এসব টাকা সংগ্রহের পাশাপাশি নিজের ও গাড়ির মালিকের জন্য টাকা জোগাড়ের ধান্ধায় চালকদের সময় কাটে হাইপারটেনশনে। ফলে আচার-আচরণে, গাড়ি চালনায় তারা চরম বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমেই লিপ্ত হন বিপজ্জনক প্রতিযোগিতায়। যাত্রী বোঝাই করে অন্য গাড়ির আগে গন্তব্যে যাওয়া আবার ফিরতি ট্রিপে টার্মিনালে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতাতেই প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা জানান, কোনো রুটের যানবাহনই চাঁদামুক্ত নয়। বরং চলাচলকারী সব গাড়িকে প্রতি ট্রিপেই ‘নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা পরিশোধের পর টার্মিনাল ছাড়তে হয়।’ সেক্ষেত্রে দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে এবং লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে প্রতি ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫০০-৭০০ টাকা। বিভিন্ন রুটে চলাচলরত গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা জানান, মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজির অত্যাচারে মালিকরা পথে বসতে চলেছে। শ্রমিকদের আয়ও কমে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মালিক বলেন, লাকসাম, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন রুটে এখন গাড়ি প্রতি ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদাবাজির শিকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিদিন দেওয়া চাঁদার তথ্য অনুযায়ী, পরিবহন-সংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নামে ৫০ টাকা, মালিক সমিতির জন্য ৮০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য ৪০ টাকা, টার্মিনাল কমিটির জন্য ২০ টাকা, কলার বয় ব্যবহার বাবদ ২০ টাকা, কেরানির ভাতা ২০ টাকা, মালিক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নামে ৫০ টাকা এবং প্রভাবশালী নেতার নামে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। টার্মিনালে মস্তান ভাতা, থানার চাঁদা, ফাঁড়ির চাঁদা, ট্রাফিক চাঁদা নামেও আলাদা আলাদা খাত রয়েছে। পরিবহন কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির অত্যাচার চলে আরও এক ধাপ বেশি। গত রবিবার গাড়ি চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত মিরপুরের জাবালে নূর পরিবহন কোম্পানি সব রকম চাঁদা আদায়ের পরও কোম্পানি চেয়ারম্যানের নামে আলাদাভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া একই রুটে অন্য কোম্পানির গাড়ি চলাচলে বাধা প্রদানের জন্য মস্তান-পুলিশকে আলাদা বখড়া দেওয়ার জন্য কোম্পানিটি বাড়তি চাঁদা উত্তোলন করে থাকে। এতসব চাঁদা-বখড়ার টাকা জোগাতে গিয়েই চালক-হেলপাররা মাত্রাতিরিক্ত বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে দৈনিক ১৫ থেকে ১৬ হাজার বাস চলে। এর মধ্যে সায়েদাবাদ থেকে সাড়ে ৩ হাজার, মহাখালী থেকে ২ হাজার ৬০০, গুলিস্তান থেকে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০, ফুলবাড়িয়া থেকে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০, মিরপুর থেকে ৮০০, আজিমপুর থেকে ৬০০, মতিঝিল কমলাপুর থেকে প্রায় ৬০০, গাবতলী থেকে ৩ হাজার ৬০০ ও ভাসমান বাস আরও ১ হাজার ৫০০। এসব বাস থেকে দৈনিক ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া থেকে রাজধানী ঢাকা ও শহরতলির ৩৪টি পরিবহন থেকে ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন সমিতির নামেই দৈনিক প্রায় ১৪ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, রাজধানীর আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, ট্রাক টার্মিনাল, স্ট্যান্ড ও বিভিন্ন পয়েন্টে পরিবহন সেক্টর ঘিরে চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। সায়েদাবাদে বিভিন্ন রুট কমিটি ভাঙা-গড়ার নামেও চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা নানা অঙ্কের চাঁদাবাজিতে মেতে আছে। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে দেশের পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের ৪৭টি রুটে চলাচলরত দুই সহস্রাধিক যানবাহন থেকে দৈনিক ফ্রিস্টাইলে চলছে চাঁদাবাজি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ ৩২টি রুটে চলাচল করে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ কোচ। একইভাবে গাবতলী, মহাখালী, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান টার্মিনাল থেকেও আরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে থাকে। উত্তরা, গাজীপুর, টঙ্গী, কালিগঞ্জ, শ্রীপুর, কাপাসিয়াসহ শহর ও শহরতলির অন্যান্য রুটে সহস্রাধিক বাস-মিনিবাসের চলাচল রয়েছে। এসব ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধভাবে গড়ে তোলা মিনি টার্মিনাল ও প্রাইভেট স্ট্যান্ড থেকে আরও দুই সহস্রাধিক দূরপাল্লার কোচ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করে। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মাওয়াঘাট, দাউদকান্দি, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জগামী বিভিন্ন পরিবহন থেকে দিনে ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা ওঠানো হচ্ছে। ফ্লাইওভারের ঠিক মাথায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর সুযোগ দেওয়ার নামেও চলছে চাঁদাবাজি। সেখানে যাত্রী ওঠানামা করাতে একটি চক্র গাড়িপ্রতি ৩০০ টাকা করে চাঁদা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাস-মিনিবাসের অঘোষিত এ স্ট্যান্ড গড়ে তোলার কারণে ফ্লাইওভারের বিরাট অংশ জুড়ে ভয়াবহ যানজটের সূত্রপাত হচ্ছে, ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। রাজধানীর গুলিস্তান টার্মিনাল ছাড়ার আগেই গাজীপুর চৌরাস্তা রুটের প্রতিটি পরিবহনের একটি বাসের জন্য চাঁদা দিতে হয় সাড়ে ৪০০ টাকা, যা ‘টার্মিনাল চাঁদা’ নামে পরিচিত।

এর বাইরে সিটি করপোরেশনের ইজারাদার ও সিরিয়ালের জন্য দিতে হয় আরও ১০০ টাকা। সব মিলিয়ে সাড়ে ৫০০ টাকা পরিশোধের পর এ রুটে একটি বাস রাস্তায় নামে। এছাড়া টার্মিনাল থেকে বের হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত যেতে ৬টি স্থানে আরও তিনশ’ টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে প্রতি যাত্রা বা ট্রিপে খরচ হয় সাড়ে ৮০০ টাকা।  চাঁদার সমুদয় অর্থ ভাগাভাগি হয়, সরকারি দল সমর্থিত বিভিন্ন মালিক-শ্রমিক সংগঠন, স্থানীয় পলিটিক্যাল ক্যাডার, পুলিশ ও সন্ত্রাসীসহ ৬ ধাপে। রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট এবং আজমপুরে বাস চালকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার চিত্র নিয়মিতই চোখে পড়ে। প্রতিটি স্পটেই এক থেকে দুই যুবক হাত উঁচিয়ে বাস থামার নির্দেশ দিলে কন্ডাক্টর তাদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতে দেখা যায়। বাস শ্রমিকরা জানান, লাইনম্যানের নামে ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক সংগঠন এ টাকা আদায় করে নিচ্ছে। একই চিত্র পাওয়া গেছে মতিঝিল-মিরপুর রুটেও। নিয়মিতহারে চাঁদা দিতে গিয়ে অনেক পরিবহন লোকসানের মুখে পড়েছে। অনেক পরিবহন বন্ধও হয়ে গেছে। তবে বেশিরভাগ পরিবহন মালিককে এভাবে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিয়েই ব্যবসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর