বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পর্যটন আছে শুধু সরকারি কর্মকাণ্ডে

বিশ্ব পর্যটন দিবস আজ

নিজামুল হক বিপুল

পর্যটন আছে শুধু সরকারি কর্মকাণ্ডে

সিলেটে মনোরম পর্যটন কেন্দ্র বিছানাকান্দি। ভাঙাচোরা রাস্তায় ভোগান্তি পোহাতে হয় পর্যটকদের — রোহেত রাজীব

প্রতিবছর ঘটা করে পালন করা হয় বিশ্ব পর্যটন দিবস। অথচ দেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তেমন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না সারা বছর। শুধু দিবস এলেই ঘটা করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দায় শেষ করেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে দেশের পর্যটনশিল্প সামনের দিকে এগোতে পারছে না। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে যে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন, প্রণোদনা প্রয়োজন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। অথচ এর কোনোটিই হচ্ছে না। এ খাতের সবকিছু চলছে ব্যুরোক্রেসির মাধ্যমে। এমনকি দেশে নান্দনিক যেসব পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোকে আরও নান্দনিক করার ক্ষেত্রেও তেমন তৎপরতা নেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দেশে প্রায় ৫০০ ছোট-বড় স্পট রয়েছে, যেগুলোর একটা বড় অংশ প্রাকৃতিক। আরও আছে ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র। দেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে প্রতিবছর দেশি-বিদেশি পর্যটকরা পর্যটন স্পটগুলোতে ভিড় করেন। ভ্রমণপ্রিয় এসব মানুষকে বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো আকৃষ্ট করলেও এ শিল্পের বিকাশে তেমন কোনো তৎপরতা নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পর্যটন করপোরেশনের। দেশে যেমন তৎপরতা নেই তেমনি বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না। দেশের পর্যটনের বিকাশে যা কিছু হয়েছে এবং হচ্ছে এর বেশির ভাগই বেসরকারি উদ্যোগে হয়েছে। সেই উদ্যোগেও অনেক সময় ভাটা পড়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতার কারণে। অথচ অপার সম্ভাবনার এই শিল্পকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করলে, ভ্রমণপিপাসুদের কাছে টানতে সরকারিভাবে আরও উদ্যোগ নিলে একদিকে যেমন পর্যটনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো, তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকাও আরও সচল হতো। বাংলাদেশে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৯৯ সালে। এর পর থেকেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এই খাত। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হলেও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আরও পর্যটকবান্ধব করে তুলতে বরাবরই দেখা গেছে সমন্বয়হীনতা। বিভিন্ন সময় পর্যটনশিল্প নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নানামুখী তৎপরতা ও পরিকল্পনা দেখা গেলেও সেগুলো বাস্তবায়নে বরাবরই ঢিলেঢালা অবস্থা। ফলে দেশের পর্যটনশিল্প সামনের দিকে এগোতে পারছে না। যে-সংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটকের প্রতিবছর বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখার কথা, সেই সংখ্যক পর্যটক আসছেন না। এখন পর্যন্ত এ খাতের যে উন্নয়ন ঘটেছে এর বেশির ভাগই ঘটেছে বেসরকারি উদ্যোগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সবাইকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে সরকারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। থাকতে হবে পর্যটনশিল্পের গাইড লাইন, যাতে দেশি-বিদেশি কোনো পর্যটককেই কোনো রকম ভোগান্তিতে পড়তে না হয়। দেশে বর্তমানে যেসব প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ সবুজে ঘেরা পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিলেটের সোয়াম ফরেস্ট রাতারগুল, ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, পানতুয়াই, জাফলং, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড, লাউয়াছড়া, মাধবপুর লেক, হবিগঞ্জের সাতছড়ি, সুনামগঞ্জের রামসারভুক্ত টাঙ্গুয়ার হাওরসহ হাওর এলাকা, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, পার্বত্য তিন জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িসহ আরও অনেকগুলো এলাকা। এসব পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘমেয়াদি তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। আর যেসব পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলোও চোখে পড়ার মতো নয়। কুয়াকাটা নিয়ে সরকারের একটি মাস্টারপ্ল্যান থাকলেও সেটি আজও আলোর মুখ দেখেনি। আর সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ে তো কোনো পরিকল্পনাই নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্ব পর্যটন দিবস এলেই আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেটি পালনের একটা বিষয় দেখা যায়। এ পর্যন্তই শেষ। তিনি বলেন, ‘আমাদের পর্যটনশিল্প অনেক সমৃদ্ধ। কিন্তু আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট পরিমাণ ধীরগতিতে এগোচ্ছে। তাদের আগ্রহের মধ্যে ভাটা আছে।’ তিনি বলেন, দেশের পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন প্রণোদনা, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, নিরাপত্তাব্যবস্থায় আরও জোর দেওয়া। ড. বদরুজ্জামান বলেন, ‘পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আরও নান্দনিক করতে হবে। যেমন ধরুন বিছনাকান্দি হচ্ছে অপার সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন কেন্দ্র। এটিকে আরও নান্দনিক ও সুন্দর করে তুলতে হবে। কিন্তু এসব কাজে সরকারের সংশ্লিষ্টদের তেমন তৎপরতা নেই।’ তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যটন নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মধ্যে পর্যটন নিয়ে পড়ালেখা করেছেন, গবেষণা করেছেন এমন লোকের সংখ্যা একেবারেই ম্রিয়মাণ। ঢাবির এই শিক্ষক বলেন, যারা এ বিষয়ে লেখাপড়া করছেন তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে এ খাতের উন্নয়নে। সঠিক জায়গায় সঠিক ও যোগ্য লোক বসাতে হবে। তাদের কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের পর্যটন মূলত ব্যুরোক্রেসির মাধ্যমে চলছে। প্রশাসনের লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে চলছে। এ কারণে এ খাতের গতি একেবারেই মন্থর।’ ড. বদরুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে খুবই আন্তরিক। এটিকে কাজে লাগাতে হবে।

সর্বশেষ খবর