শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুখ থুবড়ে পড়েছে আনিসুল হকের প্রকল্প

জয়শ্রী ভাদুড়ী

রাজধানীর যানজট কমাতে সাতরাস্তা থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি ব্যবহার নিয়ে জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় এই প্রকল্প। শুধু এই প্রকল্প নয়, আনিসুল হকের চার হাজার বাস নামানোর প্রকল্পেরও একই অবস্থা। কয়েক হাত ঘুরে এই প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন ল্যান্ডফিল্ড নির্মাণ, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মতো স্বপ্নের প্রকল্পগুলো এখন অন্ধকারে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, মেয়র আনিসুল হক হাতিরঝিলের মতো আরও ৩টি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। রাজধানীর উত্তরায় জলনিসর্গ নামে একটি প্রকল্প করার কথা ছিল তার। এ ছাড়া কল্যাণপুরের পেছনের অংশ দিয়ে গাবতলীর পাশে এবং রামপুরা কাটাসুর খালকে কেন্দ্র করে প্রকল্পের অনুমোদন প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। এর বেশির ভাগ অংশ এখনো পরিকল্পনার মধ্যেই আছে। কিছু অনুমোদন পেলেও বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকাকে ঝকঝকে করে তুলতে সড়কবাতি লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর এক বছর পার হলেও শুধু উত্তরার কয়েকটি সড়কে সড়কবাতির ব্যবস্থা হয়েছে। একটি নিরাপদ, আধুনিক ও নারীবান্ধব মহানগর গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে ২০১৫ সালের ৬ মে ঢাকা উত্তর সিটি মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আনিসুল হক। দায়িত্ব নিয়েই রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেন তিনি। রাজধানীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নগরবাসীর হৃদয়ে ঠাঁই পান আনিসুল হক। মেয়র হিসেবে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তার মোড় থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে রাস্তা নির্মাণ, গাবতলীতে ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে রাস্তা সংস্কার, গুলশান-বারিধারা কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা জোরদার, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের দখলে থাকা ফুটপাথ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা, গুলশান-বনানী এলাকা থেকে পুরনো বাস সরিয়ে ‘ঢাকা চাকা’ এসি বাস সার্ভিস চালু, ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় প্রচুর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, ‘সবুজ ঢাকা’ নামে সবুজায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে নাগরিক মহলে প্রশংসিত হন তিনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ফিরিয়ে এনেছেন জনগণের সম্পত্তি। ঢাকা উত্তর সিটির বিভিন্ন সমস্যায় দিনে-রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েও নগরবাসীর আস্থাভাজন হয়েছিলেন তিনি। তার স্মরণে তেজগাঁও-সাতরাস্তা সড়কটি মেয়র আনিসুল হক সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। আগামীকাল আনিসুল হকের স্মরণে ওই সড়কে নির্মিত নামফলক উন্মোচন করবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। আনিসুল হকের প্রকল্প বিষয়ে নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, মেয়র হওয়ার আগেই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কর্মশালা করেছিলেন আনিসুল হক। মেয়র হলে নগরের উন্নয়নে কোন বিষয়গুলোতে আগে হাত দিতে হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন আগেই। রাজধানীর যানজট নিরসনে ৬টি কোম্পানির মাধ্যমে পরিবহন খাতকে প্রায় গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। অনেক কিছু তার এখতিয়ারে না থাকলেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। এত নিখুঁতভাবে কাজ করার পরিকল্পনা এর আগে কারও দেখিনি। তার পরিকল্পিত কাজগুলো যদি তিনি শেষ করে যেতে পারতেন তাহলে সত্যিই তিলোত্তমা হতো ‘আমার ঢাকা’। আনিসুল হকের মৃত্যুতে তার স্বপ্নের প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে সাতরাস্তা থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণের পরিকল্পনা করেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। প্রকল্প বাস্তবায়নে সড়ক ও জনপথের ৩১ বিঘা, রেলওয়ের দেড় বিঘা এবং সিভিল এভিয়েশনের ১ দশমিক ৮৩ বিঘা জমির প্রয়োজন পড়ে। সংস্থাগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন মেয়র। এর মধ্যে সওজ বিভাগের জমির পরিমাণ বেশি। মেয়রের সঙ্গে আলোচনায় কোনো খরচ ছাড়াই জমি ব্যবহারের অনুমতি দেয় সওজ। কিন্তু আনিসুল হকের মৃত্যুর পর প্রকল্পের কাজ শুরু করতে গেলে বাধা দেয় তারা। প্রয়োজনীয় জমির জন্য অর্থ দাবি করলে প্রকল্প খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। থেমে যায় যাবতীয় কার্যক্রম। প্রকল্প পরিচালক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে গত ২২ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সভা হয়েছে। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের হস্তক্ষেপে গত ২৭ জুলাই সওজ ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে এই প্রকল্পে ব্যবহারে জমি দিতে রাজি হয়। প্রকল্প ব্যয়ের সঙ্গে এই ক্ষতিপূরণ যোগ করে সংশোধিত ডিপিপি গত ১৭ অক্টোবর স্থানীয় সরকার সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, উত্তরা অংশে রাজলক্ষ্মী, র‌্যাব অফিসের সামনে এবং খিলক্ষেতের কাউলা এলাকায় তিনটি ইউটার্নের কাজ শুরু হয়েছিল। প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আবার জরিপ হচ্ছে। এজন্য বর্তমানে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন সংস্থা আর কমিটির হাতে ঘুরছে রাজধানীতে চার হাজার বাস নামানোর প্রকল্প। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. জামাল মোস্তফা বলেন, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রকল্পগুলো বেশ কিছু আমরা বাস্তবায়ন করেছি। অন্য প্রকল্পগুলোও চলমান রয়েছে। আশা করি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে নগরবাসী এর সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

সর্বশেষ খবর