বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর পথের যাত্রী

মির্জা মেহেদী তমাল

ভয়ঙ্কর পথের যাত্রী

কেন খুন করেছিস বল! তোর সঙ্গে আর কে ছিল? ঢাকার গোয়েন্দা দফতরের ছোট্ট একটি রুমে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে যাচ্ছেন গোয়েন্দারা। মেঝের ওপর পড়ে থাকা চোখ বাঁধা ব্যক্তিটির যেন বিকার নেই। শুধু বলছেন, আমি জানি না স্যার। যতবার প্রশ্ন করা হচ্ছে, ততবারই এক জবাব। বিরক্ত গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এত কৌশলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এমন লোক তারা খুব কম দেখেছেন। পানি, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে বেশ কঠিন কঠিন থেরাপি দিয়েও কাজ হচ্ছে না। চোখ বাঁধা লোকটি উঠে বসতে পারছে না। নাকের নিচে জমাট বাঁধা রক্ত। মধ্যরাতে আবারও জেরা শুরু। তুই কেন স্যারের বাসায় গিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছিলি! প্রশ্ন রাখে এক গোয়েন্দা। এবার লোকটি মুখ খোলে। বলে, সত্য। আমি হুমকি দিছিলাম। কিন্তু খুন করিনি স্যার। ভয় দেখাইছি। ওই পর্যন্তই। কিন্তু আমি খুনের বিষয় কিছু জানি না। ভীষণ চিন্তিত গোয়েন্দারা। মাথায় তাদের হাজারো প্রশ্ন। তবে স্কুল স্যারকে খুন করল কে? সরকারি গভ. ল্যাবরেটরি বয়েজ স্কুলের শিক্ষক স্বপন কুমার গোস্বামী খুন হন। বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হতেই কয়েকজন কিশোর শিক্ষককে সালাম দেয়। সালামের জবাব দিতেই অস্ত্রধারীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। বেশ কয়েক বছর আগে ভূতেরগলি নর্থ রোডের চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার বিষয়ে পুলিশ আসামি ধরতে চেষ্টা করে। শিক্ষকের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর থেকে ধরে নিয়ে আসা হয় ইউনুস মেম্বারকে। জমি নিয়ে বিরোধে এই ইউনুস ঢাকায় এসে ওই শিক্ষককে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিলেন। এর কদিন পর শিক্ষক খুন হন। সন্দেহের তীর তখন ইউনুসের দিকে। সেই ইউনুসের কাছে টানা ১৮ ঘণ্টার জেরাতেও পুলিশ কোনো তথ্য পায় না। গোয়েন্দারা তাদের তদন্তের পরিধি বাড়ায়। খুনের ধরনে নিশ্চিত হয়, পেশাদার হিটম্যানের কাজ। কিন্তু পেশাদার হিটম্যানদের কারা ব্যবহার করল? গোয়েন্দারা খবর পায়, ঘটনার আগের দিন সন্ধ্যায় শিক্ষকের বাসায় কয়েকজন যুবক আসে। তারা প্রাইভেট পড়ার কথা বলেছে। কিন্তু তারা দেখতে ছাত্র মনে হয় না। এমন কথা সেই রাতেই শিক্ষকের কাছে শুনেছিল তার শ্যালক। শ্যালক বিষয়টি গোয়েন্দাদের জানিয়েছিল। এমন সব বিষয় নিয়ে গোয়েন্দারা যখন ভাবছিলেন, তখনই ফোন এলো। সোর্সের ফোন। স্যার, জিল্লুরের কাছে নতুন লোহা লক্কড় (রিভলবার) আসছে। ওর গ্রুপের পোলাপানের পকেট ভর্তি মাল। ভালো কাম করছে একটা। খালাস করছে। এমন কথা শুনে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসে। ঠিকানা নেয়। রাতেই অভিযান জিল্লুরের আস্তানায়। পুলিশের ধাওয়ায় ধরা পড়ে এক সদস্য রিফাত। গোয়েন্দা দফতরে নিয়ে জেরা। বেশি সময় লাগেনি। সব ফাঁস করে দেয় সে। পুলিশ আর সময় নেয় না। রিফাতের দেওয়া তথ্যে অভিযান চলে। ধরা পড়ে শান্তনু আর আপন নামে দুই স্কুল ছাত্র। শান্তনুর বাবা সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। এই দুই ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করে খুনের তথ্য পায়। পুলিশ হতবাক। পুলিশের জেরায় শান্তনু জানায়, স্যারকে হত্যা করতে   দেড় মাস আগে পরিকল্পনা করি। কারণ স্যার আমাকে নকলের দায়ে পরীক্ষা থেকে বহিষ্কার করে। আর আপনকে স্কুল থেকে বের করে দেয়। আমরা সহ্য করতে পারছিলাম না। শান্তনু বলে যায়, স্যারকে খুন করতে সন্ত্রাসী জিল্লুরের কাছে যাই। স্যারকে খুন করতে এক লাখ টাকা দিতে চাই। কিন্তু ওরা চায় আরও। কারণ অস্ত্র ভাড়া করতে টাকা লাগবে। তখন আমি বলি, আমার বাবা সরকারি কর্মকর্তা। উনার লাইসেন্স করা রিভলবার আছে। ওটা দিব। জিল্লুর রাজি হয়। বাসা থেকে রিভলবার নিয়ে এসে দেই জিল্লুরের কাছে। এর কয়েকদিন পর কাজ হয়ে যায়। জিল্লুর গ্রুপের সদস্য রিফাতের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, তারা শিক্ষকের বাসার কাছে আগে থেকে ওতপেতে থাকে। সকাল ৯টায় শিক্ষক বাসা থেকে  বেরুনোর পর তাকে গুলি করে হত্যা করে। পরে ফাঁকা গুলি করতে করতে পালিয়ে যাই। পরে বিচারিক আদালত শিক্ষক হত্যা মামলায় দুজনের ফাঁসি এবং একজনের যাবজ্জীবন দ  দেয়। তুচ্ছ ঘটনায় স্কুল পড়ুয়া ছাত্রদের খুনসহ বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার এমন ঘটনা এখন নিয়মিত। গত ১০ বছরে রাজধানীর আলোচিত হত্যাকাে র বেশিরভাগই স্কুল পড়ুয়া কিশোর অপরাধীদের হাতে ঘটেছে। এটি খুবই ভয়ঙ্কর তথ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, যে বয়সে নিজেকে গড়ে তোলা ও পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা, সে বয়সে এমন অপরাধে জড়ানোর কারণ কী? অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, শিথিল পারিবারিক বন্ধন, বাবা-মার সন্তানকে সময় না দেওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, স্বল্প বয়সে স্মার্টফোনসহ উন্নত প্রযুক্তি উপকরণের নাগাল পাওয়া, সঙ্গদোষ ইত্যাদি কারণে কিশোরদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল আলম বলেন, হাতের নাগালে উন্নত যোগাযোগ প্রযুক্তি, পর্যাপ্ত অর্থ, বেশি স্বাধীনতা তাদের নানা দিকে অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দেয়। তারা ভয়ঙ্কর পথের যাত্রী হয়ে উঠছে। কৌতূহলের বশে বা অজ্ঞাতসারেই তাদের পা পড়ে যেতে পারে অন্ধকার জগতে। কিশোরদের  বেপথ হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটিতে সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ। কিশোররা যেন অপরাধে জড়াতে না পারে এবং কেউ তাদের অসৎকাজে ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। এজন্য সবার আগে পরিবার তথা বাবা-মাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা কী করে, কার সঙ্গে সময় কাটায়- এসব  খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানদের অযৌক্তিক আবদার পূরণ করার আগে ভাবতে হবে। গোটা সমাজেই শিশু-কিশোরদের সুস্থ-সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ  তৈরি করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর