শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইয়াবার নতুন রুট জকিগঞ্জ

মিয়ানমার থেকে ভারত হয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে, ব্যবসায় রাজনীতিবিদ জনপ্রতিনিধি

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

ইয়াবার নতুন রুট জকিগঞ্জ

মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের নিরাপদ রুট ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া প্রভৃতি এলাকা। গেল বছর মাদকবিরোধী সর্বাত্মক অভিযানে দুই শতাধিক ‘মাদক ব্যবসায়ী’ নিহত হওয়ার পর কৌশল বদলে ফেলেছে চোরাকারবারিরা। ইয়াবা পাচারের নতুন রুট হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্তকে। বিজিবি, পুলিশের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও সীমান্তবর্তী এ উপজেলা দিয়ে এখন বানের জলের মতো ঢুকছে ইয়াবা। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুযোগ থাকায় ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিরাও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে সরাসরি ভারতের ভূখ- ব্যবহার করে সিলেট সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা একেবারে ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায় মাদক কারবারিরা এই উপজেলাকে নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে। সূত্রের তথ্যানুসারে, বর্তমানে মিয়ানমার থেকে ভারতের মণিপুর, ইম্ফল ও শিলচর হয়ে ইয়াবার চালান আসে দেশটির করিমগঞ্জে। করিমগঞ্জ হচ্ছে জকিগঞ্জ উপজেলার ঠিক উল্টো দিকে ভারতের অংশ। করিমগঞ্জ থেকেই ইয়াবার চালান ঢুকছে জকিগঞ্জে। এরপর তা চলে আসছে সিলেট নগরীতে। সেখান থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

যেসব এলাকা দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা : জানা গেছে, জকিগঞ্জ উপজেলার খলাছড়া ইউনিয়নের লোহারমহল, সুলতানপুর ইউনিয়নের অজরগাঁও, ইছাপুর, সুলতানপুর, সহিদাবাদ ও ভক্তিপুর, বারঠাকুরী ইউনিয়নের লাড়িগ্রাম ও ছালেহপুর, জকিগঞ্জ ইউনিয়নের সেনাপতির চক, মানিকপুর ও ছবড়িয়া, কসকনকপুর ইউনিয়নের বলরামেরচক এলাকা দিয়ে ভারত থেকে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে ইয়াবা পাচারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় লোহারমহল সীমান্ত এলাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে ভারতের কয়েকটি রাজ্য ব্যবহার করে জকিগঞ্জ সীমান্তের উল্টো দিকে করিমগঞ্জে ইয়াবার চালান নিয়ে আসা হয়। দেশের অন্য এলাকার চেয়ে জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার সহজ হওয়ায় মাদক কারবারিরা বর্তমানে ভারতের করিমগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে ইয়াবার কারখানা গড়ে তুলেছে- এমন তথ্য পাওয়া গেছে একাধিক সূত্র থেকে। তবে বিজিবি জানিয়েছে, তাদের কাছে এ রকম কোনো তথ্য নেই। তবে সীমান্তের কাছাকাছি এ ধরনের কোনো মাদক কারখানা গড়ে উঠেছে কি না এর খোঁজ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিজিবি কর্মকর্তারা।

যেভাবে পাচার হয় ইয়াবা : ভারত থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারে ব্যবহার করা হয় উভয় দেশের সীমান্ত নদী কুশিয়ারা ও সুরমা। ভারতের করিমগঞ্জ থেকে পলিথিন ব্যাগে ইয়াবার চালান ঢুকিয়ে লম্বা রশি লাগিয়ে ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। এপারে বাংলাদেশ সীমান্তে তখন মাছধরার নৌকা নিয়ে মাছধরার ছলে অপেক্ষায় থাকে মাদক কারবারিরা। নদীর স্রোতের টানে পলিথিনে থাকা ইয়াবার চালান ভাসতে থাকে। বাংলাদেশের মাদক কারবারিরা তখন কৌশলে সেই চালান তুলে নেয় নৌকায়। সুযোগ বুঝে তা তুলে নিয়ে আসা হয় পাড়ে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কমে গেলে ইয়াবার চালান পলিথিনে ভরে সাঁতরেও পার করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের জকিগঞ্জের সেনাপতির চকের বিপরীতে ভারতের কাঁটাতারের নিচ দিয়ে গোপন রাস্তা তৈরি করা হয়েছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে।

সীমান্ত থেকে যেভাবে ছড়ায় ইয়াবা : ভারত থেকে আসা ইয়াবার চালান সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সিলেট শহরে আনতে আগে যে রুট ব্যবহার করা হতো, বর্তমানে সেটি পাল্টে ফেলেছে মাদক কারবারিরা। সূত্র জানায়, আগে সিলেট শহরে ইয়াবার চালান নিয়ে আসতে জকিগঞ্জ-শ্যাওলা-সিলেট রুট ব্যবহার করা হতো। তারপর সে চালান ছড়িয়ে যেত সারা দেশে। তবে ওই রুটে বর্তমানে পুলিশের কড়া তল্লাশি থাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা জকিগঞ্জ-কালিগঞ্জ-সিলেট ও জকিগঞ্জ-আটগ্রাম-সিলেট রুট ব্যবহার করছে। সিলেট শহর থেকে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবার চালান পাঠানো হচ্ছে ঢাকা, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। গেল শুক্রবার সিলেট নগরীর একটি হোটেলকক্ষ থেকে সাড়ে ৫০০ পিস ইয়াবাসহ আটক হন জকিগঞ্জ পৌর যুবলীগের সদস্য শাহরিয়ার রহমান অমিত। তিনি জকিগঞ্জ থেকে ইয়াবা নিয়ে এসেছিলেন। তার কাছ থেকে ইয়াবা যাচ্ছিল ঢাকার গাজীপুরের শামীম নামের এক মাদক ব্যবসায়ীর কাছে। এ প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিলেট নগরীর দরগাহ গেইটের হোটেল হলি গেইট থেকে অমিতকে আটক করা হয়। তিনি জকিগঞ্জ থেকে ইয়াবা নিয়ে এসেছিলেন। গাজীপুরের শামীম নামের একজনের কাছে ইয়াবা সরবরাহ করতেন তিনি। এবার ইয়াবা সরবরাহের আগেই পুলিশ তাকে আটক করে।’

জড়িত রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি : জানা গেছে, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও কলেজশিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়েছেন। জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত ছয়জন ইউপি সদস্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। মূলত দ্রুত অর্থলাভের সুযোগ থাকায় মাদক ব্যবসায় ঝুঁকছেন তারা। কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ইতিমধ্যে আটকও হয়েছেন। তবে অনেকেই সরাসরি মাদক ব্যবসায় না জড়িয়ে পরোক্ষভাবে পুঁজি বিনিয়োগ করছেন। কোনো ঝুঁকি না নিয়েই প্রতি লাখে মাসে মিলছে ২০-৩০ হাজার টাকা। মাদক বিক্রির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয় ভারতে। জকিগঞ্জের কতিপয় ব্যবসায়ী এই হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। সামগ্রিক বিষয়ে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সীমান্ত এলাকা বিজিবি দেখে। ইয়াবার চালান ভিতরে এলে আমরা অভিযান চালাই। প্রায় সময়ই ২০০ থেকে ৫০০ পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারিরা ধরা পড়ে। তখন আমাদের মনে হয়, জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসছে। তবে মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত আমাদের অভিযানে অনেক মাদক ব্যবসায়ী ও বহনকারী ধরা পড়েছে। পুলিশ সব সময় সতর্ক থাকায় আমাদের সফলতাও বেশি। তবে পুলিশের তৎপরতার কারণে মাদক কারবারিরা নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করছে।’ বিজিবি সিলেট সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘চার-পাঁচ মাস আগেও সীমান্তে ৬২ হাজার পিস ইয়াবার চালান আটক করা হয়েছে। মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট চালান ধরা পড়ছে। আমরা সতর্কতা হিসেবে জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে যেসব পণ্য আসে সেগুলোর কনটেইনার ও বক্স তল্লাশি করি। সন্দেহভাজন গাড়ি, ইজিবাইক, মোটরসাইকেলও তল্লাশি করা হয়। সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে মনিটরিং করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে। সীমান্ত দিয়ে যাতে ইয়াবাসহ কোনো ধরনের মাদক আসতে না পারে সে জন্য বিএসএফের সঙ্গে নিয়মিত পতাকা-বৈঠক ও তথ্য আদান-প্রদান হয়ে থাকে। তবে ইয়াবার উৎসস্থলের ব্যাপারে বিএসএফ কখনো কোনো তথ্য দিতে পারেনি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর