শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংকট

শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংকট

শিক্ষার সব স্তরে মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংকট তৈরি হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার বাদে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানে আগ্রহী নয় মেধাবীরা। নিম্ন বেতন কাঠামো, দলীয় নিয়োগ, কোচিং বাণিজ্যের আধিপত্য, প্রাযুক্তিক অদক্ষতা, প্রশিক্ষণের অভাবে মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংকট তৈরি হয়েছে শিক্ষা খাতে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের শিক্ষা খাতজুড়ে অব্যবস্থাপনার চিত্র। শিক্ষাব্যবস্থা মুখস্থ ও কোচিংনির্ভর। শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হয় তাতে মেধাবীরা আগ্রহী হয় না। নিম্ন বেতন হওয়ায় ক্লাসরুমের চেয়ে কোচিংয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষকরা। ফলে মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংকট তৈরি হচ্ছে। শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে জোর দিতে হবে। সরকারকে শিক্ষা খাতে জোর দিতে হবে, বাজেট বাড়াতে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষাসহ শিক্ষার সব ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে সংকট। পাঠ্যবই, সিলেবাসে পরিবর্তন আনলেও সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কিন্তু শিক্ষকদের খুব কম অংশই নতুন এসব প্রযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। প্রাথমিক-মাধ্যমিকে যখন এ অবস্থা উচ্চ শিক্ষা তখন প্রশ্নবিদ্ধ দলীয়করণের বেড়াজালে। শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে বেশ কিছু কারণ। সমস্যা আরও প্রকট করেছে মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংকট।

সৃজনশীলতা বোঝেন না ১৩ শতাংশ শিক্ষক : সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছে। তবে শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই বাজারের প্রচলিত গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন। প্রাথমিকে ৯২ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে ৪৭ শতাংশ শিক্ষক পড়ানোর ক্ষেত্রে গাইড বইয়ের সহায়তা নেন। ২০১৬ সালে ‘রিসার্চ ফর অ্যাডভান্স অব কমপ্লিট এডুকেশন’ (রেস) পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, প্রাথমিকের ১৩ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। ৪৫ শতাংশ বোঝেন এবং ৪২ শতাংশ অল্পবিস্তর বুঝতে পারেন। সৃজনশীল পদ্ধতিতেও  ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থীকে গৃহশিক্ষকের সহায়তা নিতে হয়। এক-চতুর্থাংশ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্রই বুঝতে পারে না।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিয়োগ : দলীয় রাজনীতির কারণে এবং উপাচার্যের পছন্দের ব্যক্তিকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করার পাশাপাশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক পালাবদলে বদলায় উপাচার্য। প্রতি মেয়াদে নিয়োগ দেওয়া হয় পছন্দের ব্যক্তিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন উপাচার্যের সময়ে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষক নিয়োগে মেধার পরিবর্তে প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক দল এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধ করতে এবং অভিন্ন নীতিমালা প্রয়োগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। কিন্তু কাজে আসেনি কোনো পদক্ষেপ। ফলে দলীয়করণ এবং পারিবারিককরণের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছেন মেধাবীরা।

ননএমপিওদের আন্দোলনে কাটে বেশি সময় : বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ক্লাসরুম ছেড়ে রাজপথে অবস্থান, অনশন ধর্মঘটে নামতে হয় ননএমপিওভুক্ত শিক্ষকদের। মার্চেও এমপিওভুক্তির দাবিতে পাঁচ দিনের অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন ননএমপিও শিক্ষকরা। সুখে নেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। নামমাত্র বেতনে কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের জীবনযাত্রা। বেতন কাঠামোর এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না মেধাবীরা। বেতন কম হওয়ায় শিক্ষকরা ঝুঁকছেন কোচিং বাণিজ্যের দিকে। স্কুলে পড়ানোর চেয়ে কোচিংয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষকরা। সন্তানের শিক্ষা কার্যক্রমকে জোরদার করতে অভিভাবকদের লম্বা লাইন পড়ছে কোচিং সেন্টারগুলোতে।

পরিবর্তন আছে প্রশিক্ষণ নেই : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবই বদল হয়েছে সাতবার। বিভিন্ন পরীক্ষা পদ্ধতি বদলেছে চারবার, একাদশে ভর্তি পদ্ধতি একবার ও খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি বদলেছে দুবার। এর ফলে বারবার বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় আগে প্রথম অংশে লিখিত ও পরের অংশে এমসিকিউ পরীক্ষা নির্ধারিত ছিল। পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে ২০১৫ সালে সচিবালয়ে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কারবিষয়ক সভায় নেওয়া হয় নতুন সিদ্ধান্ত। বলা হয়, প্রথমে শিক্ষার্থীরা এমসিকিউ ও পরে লিখিত পরীক্ষা বা সৃজনশীল অংশের পরীক্ষা দেবে। একই সঙ্গে এমসিকিউ পরীক্ষার নম্বরও কমিয়ে আনা হয়। সরকারের মন্ত্রী, সচিবরা এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতি বন্ধের ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন। এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে ফল মূল্যায়নে জিপিএ-৫ এর পরিবর্তে ৪ করার নতুন সিদ্ধান্ত আসছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। সেখানে শিক্ষকরা মানসম্পন্ন কিনা তা জানে না সরকার। দেশে ২৩ হাজারেরও বেশি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম থাকলেও ব্যবহার জানেন না অধিকাংশ শিক্ষক। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইংলিশ মিডিয়াম, মাদ্রাসা থেকে শুরু করে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং গুণগত মান অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে পরিচালিত হতে হবে। দাতা সংস্থা এসে যে পরামর্শ দেয় সেটাই বাস্তবায়নে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। দাতা সংস্থার পরামর্শে নয়, শিক্ষাব্যবস্থা চলবে শিক্ষানীতির আলোকে।

সর্বশেষ খবর