বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিশু আইনের অস্পষ্টতায় বিচারিক বিশৃঙ্খলা

আরাফাত মুন্না

শিশু আইনের অস্পষ্টতায় বিচারিক বিশৃঙ্খলা

শিশু আইনের সঙ্গে অন্য বেশ কিছু আইনের সাংঘর্ষিক অবস্থান ও এ আইনের নানা অস্পষ্টতার কারণে নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতের মধ্যে বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে মনে করে হাই কোর্ট। ঢাকার এক শিশু আসামির জামিন আবেদনসংক্রান্ত আপিল নিষ্পত্তি করে দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট এমন মন্তব্য করে। আদালত বলে, শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিতের লক্ষ্যে অবিলম্বে আইনের সব ধরনের অস্পষ্টতা দূর করা প্রয়োজন। আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন বা স্পষ্টীকরণের আগ পর্যন্ত বিচারকদের অনুসরণের জন্য সাত দফা কার্যপদ্ধতিও রায়ে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ১ আগস্ট এ রায় দেয়। সম্প্রতি এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রদান করেছে হাই কোর্ট, যা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে। হাই কোর্টের রায় সাধারণত ইংরেজিতে দেওয়া হলেও ১৪ পৃষ্ঠার এ রায়টি দেওয়া হয়েছে বাংলায়। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম পূর্ণাঙ্গ রায়টি লিখেছেন এবং অন্য বিচারপতি এ রায়ের সঙ্গে একমত হয়েছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, শিশু আইন, ২০১৩ প্রণয়নের মূল লক্ষ্যই ছিল আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশু এবং আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের (ভিকটিম ও সাক্ষী) সর্বোত্তম স্বার্থ সংরক্ষণ। সে কারণে শিশু আদালত কক্ষের ধরন, সাজসজ্জা ও আসনবিন্যাস বিধি দ্বারা নির্ধারণ করার কথা আইনে উল্লিখিত হয়েছে; যাতে আদালতে শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। তবে দেশের শিশু আদালতসমূহে এখন পর্যন্ত শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। সে ক্ষেত্রে শিশু আদালতের বাইরে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে এ মুহূর্তে শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আদালত বলেছে, বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, শিশু আইন, ২০১৩-এ ধারা ২(১৬ক), ১৫ক এবং ১৬(৩) সংযোজিত হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের সংশয়, বিভ্রান্তি ও সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শিশু আইনের ধারা ১৫ক-এর বিধান বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ধারা ২৭, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ২৭ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৮সহ বিভিন্ন বিশেষ আইনের সঙ্গে শুধু অসংগতিপূর্ণ নয়, সাংঘর্ষিকও বটে। দৈনন্দিন বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা উচ্চারণে আমাদের দ্বিধা নেই, শিশু আইন ও আদালত নিয়ে বর্তমানে নিম্ন আদালত ও হাই কোর্ট বিভাগে এক ধরনের বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। হাই কোর্ট বলেছে, উপরোক্ত আলোচনা এবং সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এটা আদালতের সুচিন্তিত পর্যবেক্ষণ ও অভিমত হচ্ছে, শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিতের লক্ষ্যে শিশু আইনে সাংঘর্ষিক অবস্থা, বিদ্যমান অসংগতি, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। আদালত এও প্রত্যাশা করছে, এ লক্ষ্যে সরকার দ্রুততার সঙ্গে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

সাত দফা কার্যপদ্ধতি : আইনের যথাযথ সংশোধন ও স্পষ্টীকরণের পূর্ব পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও শিশু আদালতের বিচারকদের সাত দফা কার্যপদ্ধতি মেনে চলতে বলা হয়েছে রায়ে। এ কার্যপদ্ধতিগুলো হচ্ছে- এক. সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কেবল মামলার তদন্ত কার্য?ম তদারকি করবেন এবং এ-সং?ান্তে নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশনা প্রদান করবেন। দুই. রিমান্ড-সং?ান্ত আদেশ শিশু আদালতেই নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে, আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (ভিকটিম ও সাক্ষী) বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর জবানবন্দি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করতে পারবেন। তিন. তদন্ত চলাকালে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুকে মামলার ধার্য তারিখে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজিরা হতে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে। চার. তদন্ত চলাকালে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর রিমান্ড, জামিন, বয়স নির্ধারণসহ অন্তর্বর্তী যে কোনো বিষয় শিশু আদালত নিষ্পত্তি করবে এবং এ-সং?ান্ত যে কোনো দরখাস্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল হলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট নথিসহ ওই দরখাস্ত সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে প্রেরণ করবেন; এবং সংশ্লিষ্ট শিশু আদালত ওই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করবে। পাঁচ. অপরাধ আমলে গ্রহণের পূর্বে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের অধীনে কোনো আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে ‘শিশু আদালত’ হিসেবে আদেশ প্রদান করবে এবং এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারক শিশু আদালতের বিচারক হিসেবে কার্য পরিচালনা এবং শিশু আদালতের নাম ও সিল ব্যবহার করবেন। ছয়. আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো এই যে, আইন মন্দ বা কঠোর হলেও তা অনুসরণ করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংশোধন বা বাতিল না হয়। সে কারণে নালিশি মামলার ক্ষেত্রে শিশু কর্তৃক বিশেষ আইনসমূহের অধীনে সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিশেষ আদালত বা ক্ষেত্রমত, ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের বিধান ও অত্র রায়ের পর্যবেক্ষণের আলোকে অভিযোগ গ্রহণের পর প্রয়োজনীয় আইনি কার্য?ম গ্রহণের পরে অপরাধ আমলে গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কাগজাদি (নথি) সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করবে। অতঃপর ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে গ্রহণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান এবং অপরাধ আমলে গ্রহণ করলে পরবর্তীতে কাগজাদি বিচারের জন্য শিশু আদালতে প্রেরন করবেন। সাত. শিশু আইনের প্রাধান্যতার কারণে বিশেষ আইনসমূহের অধীনে জি আর মামলার ক্ষেত্রে শিশু কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের জন্য পৃথক পুলিশ রিপোর্ট দেওয়ার বিধান থাকায় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন।

সর্বশেষ খবর