শিরোনাম
শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বছরে তৈরি চার লাখ ক্রিকেট ব্যাট

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর

বছরে তৈরি চার লাখ ক্রিকেট ব্যাট

যশোর-খুলনা মহাসড়ক ধরে খুলনার দিকে ১৫ কিলোমিটার গেলেই সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নেরই ছোট্ট একটি গ্রাম মিস্ত্রিপাড়া। নাম মিস্ত্রিপাড়া হলেও প্রায় তিন যুগ ধরে গ্রামটি ‘ব্যাটের গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। কারণ এই গ্রামের বাসিন্দাদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম হলো ব্যাট তৈরি করা। ক্রিকেট খেলার অন্যতম প্রধান এই উপকরণটি তৈরি করেই ভাগ্য বদলিয়েছেন এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। কোনো জনগোষ্ঠী যখন জীবিকার নতুন কোনো উপায় খুঁজে পায়, তার পেছনে থাকে সুন্দর একটি গল্প। ফুল চাষের কারণে তিন দশক ধরে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়ন দেশে অন্য রকম এক পরিচিতি পেয়েছে। এই ফুল চাষের ওপর এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জেলার কয়েক লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। দেশে কাঁচা ফুলের বাণিজ্যিক চাষ প্রথম শুরু হয় এই ঝিকরগাছা থেকেই। সেই শুরু নিয়েও আছে স্থানীয় কৃষক শের আলী সর্দারের গল্প, যা এখন দেশ-বিদেশের অনেকেই জানেন। তেমনি সদর উপজেলার মিস্ত্রিপাড়ার নাম আস্তে আস্তে কীভাবে ব্যাটের গ্রাম হয়ে গেল, এর শুরুটা নিয়েও আছে একটা গল্প। এ গল্পের নায়ক সঞ্জিত মজুমদার।

মিস্ত্রিপাড়া নাম শুনলেই বোঝা যায় এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষেরই পেশা কাঠমিস্ত্রির কাজ করা। তিন যুগ আগের কথা। ১৯৮৪ সালে এই গ্রামেরই বাসিন্দা সঞ্জিত মজুমদার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দিদির বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি কাঠের নানা রকম কাজ দেখতে পান। কিছু কাজ আত্মস্থও করেন তিনি। দেশে ফিরে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি নতুন কিছু করার কথা চিন্তা করতে থাকেন। ক্রিকেটভক্ত সঞ্জিত সিদ্ধান্ত নেন, তিনি ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করবেন। ১৯৮৬ সালে ভাইপোকে নিয়ে শুরু করেন কাজ। প্রথমে শুধু যশোরের বাজারেই তিনি এই ব্যাট বিক্রি করতেন। দামে কম এবং মান ভালো হওযায় এই ব্যাটের চাহিদা বাড়তে থাকে। যশোর ও আশপাশের এলাকা তো বটেই, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে সঞ্জিতের তৈরি করা এই ব্যাটের সুখ্যাতি। তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মিস্ত্রিপাড়ার অনেকেই শুরু করেন ব্যাট তৈরি করা। এখন আর শুধু মিস্ত্রিপাড়া নয়, আশপাশের মহাজেরপাড়া, বলরামপুর, রুদ্রপুর গ্রামেও গড়ে উঠেছে ৬০-৬৫টি ব্যাট তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় বছরে সাত ক্যাটাগারিতে প্রায় চার লাখ পিস ব্যাট তৈরি হচ্ছে। এসব ব্যাটের পাইকারি মূল্য ২০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। সঞ্জিতের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিজের কারখানায় ব্যাট তৈরি করছেন মিস্ত্রিপাড়ার তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বছরে তার কারখানায় ১৬ হাজার ব্যাট তৈরি হয়। ভালো মানের একটি ব্যাট তৈরি করতে ৭০-৭৫ টাকার কাঠ লাগে। এরপর আছে শ্রমিকের মজুরি, হাতল, গ্রিপার, স্টিকার, পলিথিনসহ আরও অনেক কিছুর খরচ।

তরিকুল বলেন, তারা সাধারণত নিম, ছাতিয়ান, কদম, পিউলি, পুয়ো, ডেওয়া প্রভৃতি গাছের কাঠ দিয়ে ব্যাট তৈরি করেন। তিনি বলেন, ২০-৩০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকায় তারা এখন খুব সহজেই বিশ্বমানের ব্যাট তৈরি করতে পারবেন। সাকিব, তামিম, কোহলিরা যে ব্যাটে ক্রিকেট খেলেন সেগুলোই উইলো কাঠে তৈরি হয়। যদি বিদেশ থেকে এই উইলো কাঠ আমদানি করা যায়, তাহলে তারা খুব সহজেই কম খরচে বিশ্বমানের ব্যাট তৈরি করতে পারবেন, যেগুলো বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

ব্যাট তৈরির কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক শ শ্রমিকের। ১০০ ব্যাট তৈরি করে দিলে তারা এক থেকে দেড় হাজার টাকার মজুরি পেয়ে থাকেন। একজন শ্রমিক সপ্তাহে ৪০০ ব্যাট তৈরি করতে পারেন।

এই গ্রামেরই সুবল মজুমদার বলেন, তারা টেনিস বলে ক্রিকেট খেলার উপযোগী ব্যাটই কেবল তৈরি করেন। পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র- বছরের এই চার মাস ব্যাটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। এ সময়ে সব কারখানা সচল থাকে। বছরের অন্য মাসগুলোতে ব্যাট তৈরি করে মজুদ করে রাখেন তারা। এগুলো যশোর ও আশপাশের এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুরসহ দেশের অন্য জেলাতেও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার ব্যাট কারখানার মালিকরা বলছেন, সারা দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে ব্যাটের চাহিদাও। আর্থিক সহযোগিতা পেলে তারা কারখানা বড় করে উৎপাদনও বাড়াতে পারবেন। এজন্য সরকারের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তারা বলেন, ব্যাটের কারখানাগুলোতে কয়েক শ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কারখানাগুলো বড় হলে আরও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এর পাশাপাশি উইলো কাঠ আমদানি করতে পারলে তারা আন্তর্জাতিক মানের ব্যাট তৈরি করে বিদেশেও রপ্তানি করতে পারবেন। এদিকেও নজর দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ করেছেন তারা।

সর্বশেষ খবর