বাংলাদেশ থেকে নারী-শিশু পাচারে আরও কৌশলী হচ্ছে পাচারকারী চক্র। সন্দেহ এড়াতে পাচারে নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে তারা। এতে বাংলাদেশ থেকে নারী ও মেয়েশিশু পাচার দিন দিন বাড়ছে। জানা গেছে, পাচারকারীরা এখন বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের পাশের দেশ ভারতে পাচার করে দিচ্ছে। পাচারের সময় তারা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে পাচারের শিকার শিশু ও নারীকে নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। সন্দেহ এড়াতে পাচারকারীরা ভুক্তভোগী নারী ও মেয়েশিশুদের নিজের মেয়ে, বোন ও স্ত্রী বলে পরিচয় দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে পাচারকারী ব্যক্তি বিয়ে করছে এবং ভারতে বেড়ানোর কথা বলে বা চাকরির আশ্বাস দিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। পাচারের শিকার ভুক্তভোগীরা দেশে ফিরে আসার পরও নিরাপদ নয়। কারণ, পাচারকারীরা পুনরায় পাচার করার উদ্দেশ্যে তাদের ওপর নজর রাখে। বিয়ের এক মাস পর বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি নারী পাচার সিন্ডিকেটের কাছে রহিমাকে (ছদ্মনাম) বিক্রি করে দেয় তার স্বামী। রহিমা ১৮ বছর বয়সেই পারিবারিকভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন এবং বিয়ের এক মাস পরই স্বামীর অসদুদ্দেশ্যে বুঝতে পারেন। বেড়ানোর নাম করে বেঙ্গালুরু নিয়ে একটি নারী পাচার সিন্ডিকেটের হাতে রহিমাকে তুলে দেয় স্বামী। এরপর বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে রহিমাকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এ কাজে রাজি না হলেই তার ভাগ্যে জুটত নির্মম শারীরিক নির্যাতন। তাকে খাবার খেতে দেওয়া হতো না। জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকায় পোড়ানো হতো রহিমার শরীর। রহিমাকে তিন বছর ধরে এই অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। এরপর পরিচিত একটি পরিবারের সহয়তায় রহিমাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। রহিমা সে সময় গর্ভবর্তী ছিলেন। দারিদ্র্য্যের কারণে পাচারকারীদের ফাঁদে পড়েন বিউটিও (ছদ্মনাম)। এক ছেলের সঙ্গে বিউটিকে তার পরিবার বিয়ে দেয়। কিন্তু বিয়ের এক সপ্তাহ পর বিউটিকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে ভারতে পাচার করে দেয় তার স্বামী। মুম্বাই শহরের এক পতিতালয়ে বিক্রি করা হয় বিউটিকে। সেখানে একটি রুমে আটকে রেখে অসংখ্যবার ধর্ষণ করা হয়। এ ছাড়া আবাসিক হোটেলে নিয়েও তাকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো হতো। রাজি না হলে তার শরীর ব্লেড দিয়ে কেটে ক্ষতবিক্ষত করা হতো। অবশেষে এক ব্যক্তির সহায়তায় বিউটি তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পান। এরপর এক দেশীয় দালালের সহায়তায় বিউটি সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনিও তখন গর্ভবতী ছিলেন। রহিমা-বিউটির মতো এই করুণ পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে পাচারের শিকার বাংলাদেশি নারীদের।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, ভারতীয় সীমান্তে বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে পাচারকারীরা নারী-শিশুদের পাচার করছে। এ ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশনে পাচারের শিকার নারীকে তার পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হিসেবে তারা মিথ্যা বিয়ের সার্টিফিকেট বা ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করছে। কিছু পাচারকারী পাচারের শিকার নারী ও মেয়েশিশুদের নিজের মেয়ে, বোন ও স্ত্রী বলে পরিচয় দিচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে তারা বিয়ে করে পরে ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারিতে যশোরের আদালতে নড়াইলের সোহাগ হোসেইনকে তার স্ত্রীকে মুম্বাইয়ের একটি পতিতালয়ে বিক্রির অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদ ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন নিউজের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনমতে, পাচারের শিকার ভুক্তভোগীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার পরও পাচারকারীরা তাদের ওপর নজর রাখে। আর পাচারকারী যদি বুঝতে পারে ভুক্তভোগী সেই নারী আর আয়-রোজগার করতে পারছে না এবং পরিবারও সেই নারীকে সহযোগিতা করছে না তখন পাচারকারীরা আবারও তাকে পাচার করার ফন্দি আঁটে।সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতের মুম্বাই, হায়দরাবাদ ও কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি নারী ও মেয়েশিশুদের পাচার করা হচ্ছে। পাচারের শিকার ৬০ ভাগেরই বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের পাচারকারী সিন্ডিকেট নানা প্রলোভন দেখিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারী-শিশুদের তুলে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। হাতবদলের পর কলকাতা, মুম্বাই ও হায়দরাবাদের পাচারকারীরা নারী-শিশুদের সেখানকার পতিতালয়ে তুলে দিচ্ছে। চীনের কিছু নাগরিক বিয়েসহ মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি নারীদের পাচারের সঙ্গে যুক্ত। ভারতে চাকরি দেওয়ার কথা বলেও অনেক মেয়েকে পাচার করা হচ্ছে। আবার বাংলাদেশের কন্যাশিশু পাচারের অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে বাল্যবিয়ে।
গত ছয় বছরে শুধু খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়টি জেলা থেকে পাচারের শিকার ৩১১ জন নারী-শিশুকে ভারত থেকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। আর গত আট বছরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্র থেকে পাচার হওয়া ১ হাজার ৭৫০ বাংলাদেশি নারীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এই নারী ও শিশুদের উদ্ধারের পর তারা ভারতের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় অবস্থান করছিল। তবে আরও অনেক বাংলাদেশি নারী বর্তমানে দেশে ফেরার অপেক্ষায় ভারতীয় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় অবস্থান করছেন। মূলত যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নড়াইল, কুষ্টিয়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের ১৮টি পয়েন্ট বাংলাদেশ থেকে নারী-শিশু পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর পাচারের জন্য খুলনার ফুলতলা, ডুমুরিয়া, দাকোপসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।