মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি

একশ্রেণির পরিবহন শ্রমিক, সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সম্মিলিত চাঁদাবাজ চক্র

সাঈদুর রহমান রিমন

পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি

পরিবহন খাতে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য থামাতে পারছে না কেউ। চাঁদাবাজদের অপতৎপরতা রোধে র‌্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা পরিবহন চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকায় প্রশাসনিক সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়। রাজধানীর শতাধিক পয়েন্টে এ চাঁদাবাজি এখন অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে। সারা দেশে চাঁদাবাজির পয়েন্ট প্রায় ৯০০। একশ্রেণির পরিবহন শ্রমিক, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সম্মিলিত চাঁদাবাজ চক্র। তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে যানবাহনের চালক, মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। সন্ত্রাসীরা সরাসরি ‘চাঁদা’ তুললেও পরিবহন শ্রমিকরা চাঁদা নেন শ্রমিক কল্যাণের নামে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা টাকা তোলেন মাসোহারা হিসেবে। এ ছাড়া আছে বেকার ভাতা, রাস্তা ক্লিয়ার ফি, ঘাট ও টার্মিনাল সিরিয়াল, পার্কিং ফি নামের অবৈধ চার্জ। এমন নানা নামে, নানা কায়দায় চলছে এ চাঁদাবাজির ধকল। ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে বিরাজ করছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। সায়েদাবাদ-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী একাধিক মিনিবাস চালক বলেন, ‘নানামুখী চান্দা-ধান্দার কবলে চালক, মালিক, শ্রমিক সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যাত্রীরা হচ্ছেন নানা দুর্ভোগের শিকার।’ মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদসহ সব বাস-ট্রাক টার্মিনালের অবস্থাই অভিন্ন। এসব স্থানে গাড়ি ঢুকতেও টাকা লাগে, বেরোতেও লাগে টাকা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপে চলছে পুলিশের চাঁদাবাজি। রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কের যত্রতত্র পুলিশের বিশেষ চেকিং আর মাসোহারা আদায়ের প্রতিযোগিতা বন্ধের সাধ্য যেন কারও নেই। রাজধানীর এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে ট্রাকপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা গুনতে হয়। ট্রাকচালকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আগে সাধারণত ঢাকার যে কোনো একজন সার্জেন্টকে ১০০ টাকা দিয়ে স্লিপ সংগ্রহ করলে সিটির মধ্যে আর কোথাও পুলিশকে চাঁদা দিতে হতো না। কিন্তু বর্তমানে এক সার্জেন্ট অন্য সার্জেন্টের স্লিপকে পাত্তা দেন না, আলাদা আলাদাভাবেই টাকা দিতে হয় তাদের। চাঁদাবাজির নানা ধরন : রয়েছে থানার চাঁদা, ফাঁড়ির চাঁদা, বোবা চাঁদা, ঘাট চাঁদা, স্পট চাঁদা। পুলিশ হাতায় মাসোহারা। মালিক-শ্রমিকের কল্যাণ ফি। রুট কমিটি-টার্মিনাল কমিটির চাঁদাও চলে বাধাহীনভাবে। সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে পুলিশের টোকেন-বাণিজ্য। এমন নানা নামে চাঁদাবাজি চলে পরিবহনে। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, সায়েদাবাদ থেকে দেশের পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের ৪৭টি রুটে চলাচলরত দুই সহস্রাধিক যানবাহন থেকে দৈনিক ফ্রিস্টাইলে চলছে চাঁদাবাজি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ ৩২টি রুটে প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ কোচ চলে। এ ছাড়া রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল, মহাখালী, উত্তরা, গাজীপুর, টঙ্গী, কালিগঞ্জ, শ্রীপুর, কাপাসিয়াসহ শহর ও শহরতলির অন্যান্য রুটে সহস্রাধিক বাস-মিনিবাসের চলাচল রয়েছে। বাস-মিনিবাসের চালক ও শ্রমিকরা জানান, চাঁদা না দিয়ে কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে বাইরে বের করার সাধ্য কারও নেই। চাঁদা নিয়ে টুঁশব্দ করলে নির্যাতনসহ টার্মিনাল ছাড়া হতে হয়। রাজধানী থেকে চলাচলকারী দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে। আর লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। বিভিন্ন রুটে চলাচলরত গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা জানান, নানা রকম কমিটির দখলদারি আর মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজির অত্যাচারে মালিকরা পথে বসতে চলেছেন। শ্রমিকদের আয়ও কমে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মালিক বলেন, লাকসাম, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন রুটে এখন গাড়িপ্রতি ১২৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদাবাজির শিকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিদিন চাঁদা প্রদানের বিস্তারিত তালিকা তুলে জানান, পরিবহন-সংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নামে ৫০ টাকা, মালিক সমিতি ৮০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ৪০ টাকা, টার্মিনাল কমিটি ২০ টাকা, কলার বয় ব্যবহার বাবদ ২০ টাকা, কেরানির ভাতা ২০ টাকা, মালিক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নামে ৫০ টাকা এবং একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার নামে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।

জিম্মি ২০ লাখ পরিবহন শ্রমিক : তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদাবাজদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন অসহায় ২০ লাখ পরিবহন শ্রমিক। পরিবহন শ্রমিকরা জানান, প্রতিদিন চাঁদা আদায়ের কাজটি করে থাকে ‘লাঠি বাহিনী’, ‘যানজট বাহিনী’ ও ‘লাইন বাহিনী’। চাকা ঘুরলেই চলে টাকার ছড়াছড়ি। টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের হওয়ার আগেই একেকটি গাড়িকে ‘জিপি’ নামক চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। এটি আদায় করে লাঠি বাহিনী। টার্মিনালমুখেই যানজট বাহিনীকে দিতে হয় ২০ টাকা ‘কাঙালি চাঁদা’। এরপর লাইনম্যানের পালা। এ ক্ষেত্রে দিতে হয় ৩০ টাকা। এর বাইরে রয়েছে টার্মিনালের টোল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রভাতী বনশ্রী পরিবহনের এক বাসচালক জানান, একদিন তার গাড়ি চালানোর জন্য ১৪০০ টাকা চাঁদা গুনতে হয়। এর মধ্যে মালিক সমিতিকে ৯৬০ টাকা জিপি নামক চাঁদা, বোবা নামক চাঁদা ২০০ টাকা, ঢাকা সড়কের নামে ৮০ টাকা, হরতালে-ভাঙচুরের ভর্তুকির নামে ২০ টাকা, অফিসে কেনাকাটার নামে ২০ টাকা, কমিউনিটি পুলিশ ২০ টাকা, সিটি টোল ২০ টাকা, সুপারভাইজার চাঁদা ৬০ টাকা ও ‘ইফতার চাঁদা’ হিসেবে ২০ টাকা দিতে হয়। যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, দৈনিক চাঁদা ছাড়াও ফুলবাড়িয়া গুলিস্তান স্টপওভার বাস টার্মিনালে প্রতিটি বাস নামানোর সময় এককালীন ২০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে প্রভাতী বনশ্রী, ডি-লিংক, আজমেরী ও এয়ারপোর্ট পরিবহনে নতুন বাস নামাতে গেলে বাসপ্রতি ২ লাখ টাকা এককালীন চাঁদা গুনতে হয়। গ্রামীণ, সেবা, শুভযাত্রা, গাজীপুর পরিবহন, ঢাকা পরিবহন, স্বাধীন পরিবহন, যমুনা, নগর পরিবহন ও দীঘিরপাড় পরিবহনের নতুন বাস নামাতে গুনতে হয় ১ লাখ টাকা চাঁদা। এ ছাড়া স্কাইলাইন, দিশারী, তানজিল, ইটিসি, ইউনাইটেড, সাভার পরিবহন, ডিএম পরিবহন ও এসএস পরিবহনের নতুন গাড়ি নামানো জন্য দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। বৈশাখী, ডিএনকে, যুবদোহার, ভিক্টর ও সময় নিয়ন্ত্রণ পরিবহনের বাস নামাতে গেলে বাসপ্রতি ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় পরিবহন মালিকদের। ইটিসি পরিবহনের মালিক মো. খালেক বলেন, রাস্তায় গাড়ি নামালেই প্রতিদিন ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের মালিক সমিতি সাত বছর আগে রমজানে ২০ টাকা ইফতারের চাঁদা চালু করেছিল। তারপর আর এই ইফতারের চাঁদা আদায় বন্ধ হয়নি। সারা বছরই মালিক সমিতির নেতারা ইফতারের চাঁদা আদায় করেন। হরতালের সময় গাড়ি ভাঙচুর হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে চাঁদা আদায় করা হয়, তার সুবিধাও জোটে না পরিবহন মালিকদের ভাগ্যে। এসব বিষয় নিয়ে মালিক সমিতির কারও সঙ্গে কোনো কথা বলার সুযোগও পান না গাড়ির মালিকরা। সারা বছর শুধু তাদের টাকাই দিতে হয়।

সর্বশেষ খবর