শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পর্যটন ও হস্তশিল্পে বদলে গেছে পাহাড়ের জীবনমান

মানিক মুনতাসির, পার্বত্য এলাকা থেকে ফিরে

পর্যটন ও হস্তশিল্পে বদলে গেছে পাহাড়ের জীবনমান

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ের ঢালে পিচঢালা পাকা পথে দিনরাত ছুটছে পর্যটকদের গাড়ি। এ এলাকায় চোখে পড়বে পাহাড়ের চূড়ায় বসবাসকারীদের বাড়ির ছোট আঙিনাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের ফলফলাদির গাছ। কোথাও কোথাও ঘরে ঘরে হস্তশিল্প। পর্যটন স্পট ঘিরে ছোট-বড় হোটেল, মোটেল আর পাহাড়বাসীর ঐতিহ্যবাহী নানা পদ খাবারের রেস্তোরাঁ। রাস্তার ধারে ছোট ছোট দোকান। নিজ বাড়ির আঙিনায় মেয়েরা নানা ধরনের কাপড় বুনছেন। সেই সঙ্গে তৈরি করছেন পরিবারের ব্যবহার্য বিভিন্ন তৈজসপত্র। ফলে এ এলাকায় অর্থনীতির চাকায়ও গতি এসেছে। পার্বত্যবাসীর ঘরে ঘরে দামি মোটরবাইক, যা তাদের সার্বিক জীবন যাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দুর্গম পাহাড়েও জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। চলছে টেলিভিশন। আবার কোথা কোথাও সৌর বিদ্যুতের আলোতে জ্বলছে বাতি, চলছে টেলিভিশন। ফলে নানা চড়াই-উতরাই আর সন্ত্রাসের বাধা ডিঙ্গিয়ে পাহাড়িদের জীবন যাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। দুর্গম পাহাড়বাসীকে এখন আর শুধু বন জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণের জন্য নির্ভর করতে হয় না। এমন কি রাঙামাটি শহরে সুস্বাদু কাবাবের দোকানও গড়ে উঠেছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝিড়ির পানির ওপর নির্ভরতা কমেছে, দুর্গম এলাকায়ও পৌঁছে গেছে সুপেয় পানি।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য অঞ্চলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনাও বেড়েছে। ফলে দুর্গম পাহাড়ের ঢালে গড়ে তোলা পিচঢালা পাকা পথে দিনরাত ছুটছে পর্যটকদের গাড়ি। পাহাড়ি মহল্লায় গড়ে উঠেছে সরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিক, স্কুল কলেজসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমনকি রাঙামাটির শুভলং এলাকায় কাপ্তাই হ্রদের পানিবেষ্টিত বরকল এলাকায় ধামাইছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। বন বিভাগের অফিসের পাশেই গড়ে উঠেছে এলাকার বাজার। রাঙামাটি শহরে যাত্রা শুরু করেছে মেডিকেল কলেজ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইতিমধ্যে পঞ্চম ব্যাচের কার্যক্রমও শেষ হয়েছে। আগামী বছরই এমবিবিএস ডাক্তার ও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবনের প্রবেশ করতে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠান দুটির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাক্তার টিপু সুলতান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নানা চড়াই-উতরাই সত্ত্বেও প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আগামী বছরই তাদের পেশা জীবন শুরু করতে পারবেন। তাদের সামগ্রিক পারফরমেন্সও খুবই সন্তোষজনক। তবে নতুন ভবনের কাজ শুরু করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। একটি গোষ্ঠী না বুঝেই এর বিরোধিতা করছে। তবে আশা করি দু-এক মাসের মধ্যেই কলেজের স্থায়ী ভবনের কাজ শুরু হবে।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে সব ধরনের কাজকর্মে প্রাণচাঞ্চল্য বেড়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় কিংবা গহিন বন থেকে সংগৃহীত ফলমূলই ছিল এক সময় এ এলাকার মানুষের একমাত্র খাদ্যপণ্য। কিন্তু সে চিত্র পাল্টে গেছে। পাহাড়ে পাহাড়ে গড়ে উঠেছে পর্যটন এলাকা। বিভিন্ন ধরনের রিসোর্ট। ঐতিহ্যবাহী বাহারি খাবারের রেস্টুরেন্ট। রিসোর্টে রয়েছে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা। ফলে নির্বিঘ্নে রাত কাটাচ্ছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা পর্যটকরা। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির গহিন বনের ভিতরে পিচঢালা রাস্তা তৈরি হয়েছে গত কয়েক বছরে। ফলে নীলাচল, নীলগিরি, শুভলং ঝরনা, সাজেক, গুইমারাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যটকরা নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পর্যটন, জুমচাষ, তাঁতবস্ত্র, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতি। চিরসবুজের ছোঁয়া পেতে পাহাড়ি জেলাগুলোয় পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পর্যটকেরা। পাহাড়ে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন এখানকার পাহাড়ি-বাঙালি মানুষের রুটি-রুজিও। শীতের সময় পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হস্তশিল্পের তৈরি শোপিস, কোমর তাঁতের কাপড়সহ ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাগুলোর বেচা-বিক্রিও জমে ওঠে। পর্যটকবাহী গাড়িগুলোসহ পরিবহন ব্যবসাও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এলাকাবাসীসহ পর্যটকদের নিরাপত্তায় পুলিশ প্রশাসন সার্বক্ষণিক সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আগের তুলনায় এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে। অর্থনীতিতে শক্তির সঞ্চার ঘটেছে। পর্যটকরা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবন মানেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সর্বশেষ খবর