মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

বিপন্নের তালিকায় বনরুই

মোস্তফা কাজল

বিপন্নের তালিকায় বনরুই

বিশ্বে মহাবিপন্নের তালিকায় চলে এসেছে আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণী বনরুই। এ প্রাণীর অস্তিত্ব ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। বাংলাদেশের বনগুলোতেও এদের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে আইইউসিএন বাংলাদেশ এ প্রাণীকে লাল তালিকা বা মহাবিপন্নের তালিকাভুক্ত করেছে।

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানান, বনরুইকে একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী বলা হয়। এ প্রাণীর সারা শরীরে মাছের মতো আঁশের ফাঁকে ফাঁকে আছে শক্ত লোম। স্বভাবে এরা অতি অদ্ভুত। কুঁজো হয়ে দুলতে দুলতে চলে। লম্বা লেজ থাকায় গাছের ডালে জড়িয়ে ঝুলেও থাকতে পারে। বিপদ বুঝলে সামনের দুই পায়ের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরো দেহ ঢেকে বলের মতো করে নেয়। একবার সামনের পা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে শক্তিশালী প্রাণীও সহজে এদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ-এর সহকারী গবেষক অনিমেষ ঘোষ অয়ন জানান, বাংলাদেশে মোট ১১টি সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলে বনরুইয়ের ওপর জরিপ করা হয় ২০১৮ সালে। এর মধ্যে ৮টি বনেই পাওয়া যায় বনরুইয়ের অস্তিত্ব। তখন চট্টগ্রাম, সিলেট এবং মৌলভীবাজারের বিভিন্ন বনে চায়না প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মেলে। তিনি জানান, এ প্রাণী সারাদিন গর্তে ঘুমিয়ে সময় কাটায়। রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়। তখন এ প্রাণী মাটি শুকতে থাকে। পিঁপড়ার বাসা বা উইপোকার ঢিবির খোঁজ পেলে শক্তিশালী নখের থাবা দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে। এরা মাটির নিচে প্রায় ছয় মিটার গর্ত করে বাসা বাঁধে। শীতকাল প্রজনন মৌসুম। সাধারণত একটি বা দুটি বাচ্চা দেয়।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ পরিষদ (আইইউসিএন) বলছে, বর্তমানে বিশ্বের মহাবিপন্নর তালিকায় রয়েছে এই বনরুই। অবাধ শিকার, পাচার, বাসস্থান নষ্টের কারণে এ অবস্থা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী পাচার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রাফিক’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০-২০১৫ সালের মধ্যে বনরুই পাচারে ব্যবহৃত মোট ১৫৯টি রুট পাওয়া গেছে। বনরুইয়ের এক কেজি মাংস ৩৫০-৫০০ ডলারে বিক্রি হয়। চায়না এবং ভিয়েতনামে এর চাহিদা বেশি। প্রতি বছর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চায়না, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০ টন বনরুই পাচার হয়। এ বিষয়ে প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ-এর তথ্য বলছে, ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত একটানা চার বছর বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে ১৯ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা গেলেও কোনো বনরুইয়ের দেখা মেলেনি। এ অবস্থার কারণ সম্পর্কে গবেষকরা বলছেন, এসব বনাঞ্চলে মিলেছে বনরুই শিকারের আলামত। মূলত বনরুইয়ের মাংস ও আঁশের জন্য এটি শিকার করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বনরুই শিকারের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশে ২০১৬ সালে বনরুইয়ের এক কেজি মাংসের দাম ২০০-৪০০ ডলার ছিল, বর্তমানে যা ৫০০ ডলারে পৌঁছেছে। পার্বত্য অঞ্চলে শিকার করা বনরুই বিশেষত আলীকদম এবং থানচি হয়ে পাচার হয় মিয়ানমারে। সেখান থেকে চলে যায় চায়নায়। বনরুই পাচারের অস্তিত্ব মিলেছে মৌলভীবাজার জেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বন ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভিতরেও। এ অবস্থায় ২০১৯ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ’ এ প্রাণীকে বাংলাদেশের জন্য ‘মহাবিপন্ন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর