দুই বছর আগে বেশ কিছু জাপানি কোম্পানি দেশের তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিল। তখন এই খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন, ইপিজেড এলাকার বাইরে পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হলে দেশের গার্মেন্ট শিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কিন্তু প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ ও মহামারী ‘কভিড-১৯’ এর কারণে পরিস্থিতি এতটা বদলে গেছে যে, এই খাতের উদ্যোক্তারা এখন উল্টো নিজেরাই বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সুপারিশ করেছেন। গার্মেন্ট শিল্পের উদ্যোক্তারা চাইছেন, একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে দেশের তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ‘বাংলাদেশের সম্ভাবনা’ বিদেশি উদ্যোক্তাদের কাছে দ্রুত তুলে ধরা হোক। তারা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কম মূল্যের সীমিত বৈচিত্র্যের পোশাক নিয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বাজারে এখন টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে আসিয়ানভুক্ত দেশ বিশেষ করে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোক্তাদের সামনে দেশের তৈরি পোশাক খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ অথবা যৌথ বিনিয়োগের বিষয়ে কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা যেতে পারে। করোনা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক গ্রুপ আইএফসির এক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর প্রেসিডেন্ট ড. রুবানা হক প্রাইরিটাইজিং এফডিআই ফর দ্য সাসটেইনড গ্রোথ অব বাংলাদেশ ইকোনমি’ শীর্ষক এক উপস্থাপনায় এসব সুপারিশ তুলে ধরেন। মূলত তিনটি সুবিধাকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যেতে পারে বলে বিজিএমইএর উপস্থাপনায় তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- (১) উচ্চ মূল্যের তৈরি পোশাক ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সুযোগ, (২) প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ এবং (৩) শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা। এ বিষয়ে ড. রুবানা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িত যে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প রয়েছে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী এখন উচ্চমূল্যের ফ্যাশনেবল পোশাকের চাহিদা বেড়েছে, বিশেষ করে ম্যান মেইড ফেব্রিকস-এর তৈরি পোশাক দিয়ে চীন এগিয়ে যাচ্ছে। এখন সময় হয়েছে, বাংলাদেশে এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের। বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট তার উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থানান্তর করলে শ্রমমূল্য কম পড়বে-এটিই একমাত্র সুবিধা নয়, বরং সাম্প্রতিককালে যে ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ বাড়ছে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তা থেকেও সুরক্ষিত থাকতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ নিরাপদজনক হবে। এমন কি যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সবচেয়ে লাভবান ভিয়েতনামও বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থানান্তর করতে পারে। এই সুবিধাটি গ্রহণ করতে হবে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের শতকরা ৭৪ ভাগই কটন বেইজড। মূলত পাঁচটি বেসিক আইটেমের ওপর দেশের ৭৫ শতাংশ পণ্য তৈরি হয়। আবার এসব পোশাক তৈরি করতে অন্তত ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ওভেন ফেব্রিক আমদানি করতে হয়। স্বল্প বৈচিত্র্যের কটনবেইজড পোশাক দিয়ে খুব বেশি দিন বিশ্ববাজারে টিকে থাকা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তারা। বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ টানার যুক্তি দিয়ে বলেছেন, দেশের তৈরি পোশাক শিল্প থেকে বছরে ৪ লাখ মেট্রিক টন ঝুটপণ্য উৎপাদিত হয়। শুধুমাত্র এই ঝুট রিসাইকেল করে যদি সুতা উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে অন্তত এই খাতে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করা স¤ভব। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে বিভিন্ন ধরনের স্পেয়ার পার্টস ব্যবহৃত হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৭ ধরনের পার্টস আমদানিতে ১ হাজার ৬০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে। এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এলে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া দেশের টেক্সটাইল কেমিক্যাল মার্কেটের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বিজিএমইএর প্রেজেন্টেশনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারের পূর্বাভাস অনুযায়ী দেশের টেক্সটাইল কেমিক্যালের বাজার ২০১৯ সালে যেখানে ৮৬৪ মিলিয়ন ডলার ছিল, সেটি বেড়ে ২০২৪ সালে ১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে। পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনা পরবর্তী একটি নতুন আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ অপেক্ষায় রয়েছে দেশের গার্মেন্ট শিল্পের জন্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদেশি বিনিয়োগ টানতেই হবে। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িত যে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প রয়েছে, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের তৈরি পোশাক খাত মূলত কটন বেইজড। এখানে ম্যান মেইড ফেব্রিক্সের কারখানা নেই। এ ধরনের কারখানা করতে অনেক বেশি পরিমাণ মূলধন প্রয়োজন, যা দেশি বিনিয়োগকারীদের পক্ষে সম্ভব না। ফলে তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ টানা এখন সময়ের দাবি।