বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

কমছে নদীর পানি

চার দফা বন্যায় ক্ষতি ৫৯৭২ হাজার কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

গঙ্গা ছাড়া দেশের সব প্রধান নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। আত্রাই, ধলেশ্বরী ও পদ্মার পানি এখনো বিপৎসীমার ওপরে থাকলেও গত ২৪ ঘণ্টায় নদী তিনটির পানি সমতল চার থেকে ছয় সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। এতে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এরই মধ্যে ক্ষতি হয়ে গেছে পাঁচ হাজার ৯৭২ কোটি টাকার বেশি। বন্যা ও নদী ভাঙনে লাখ লাখ মানুষ হারিয়েছে ঘরবাড়ি, ভিটে-মাটি, জমির ফসল, চাষের মাছ। বন্যার পানি নামলেও এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি বন্যাদুর্গতরা। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে অর্ধাহারে, অনাহারে কাটছে দিন। টাকার অভাবে মেরামত করতে পারছে না থাকার ঘরটি।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান গতকাল জানিয়েছেন, বন্যায় দেশের ৩৩  জেলায় বিভিন্ন খাতে মোট পাঁচ হাজার ৯৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৬ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা দেশের সব জেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন পেয়েছি। বন্যায় ঘরবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র, গবাদিপশু, শস্য খেত, বীজতলা, মৎস্য খামার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ লাইন, ফোন লাইন,  টেলিফোন টাওয়ার, সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, বাঁধ, নদী, হাওর, নৌকা-ট্রলার, জাল, বনাঞ্চল, নার্সারি, কৃষি, নলকূপ, জলাধার, হাসপাতাল-ক্লিনিক ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেদন পেয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা। সব মন্ত্রণালয় তাদের কর্মপরিকল্পনা পেশ করেছেন। সেই অনুযায়ী পুনর্বাসন পরিকল্পনা করা হবে।’ গতকাল সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী দ্রুত পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চালু করতে বলেছেন। যেখানে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন সেই পরিমাণ অর্থ খরচ করতে বলেছেন। আরও অর্থের প্রয়োজন হলে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বরাদ্দ দেবেন। তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ঘরবাড়ির ওপর। কারণ, পানি নেমে গেছে, লোকজন বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। এই সময়ে ঘরগুলো ঠিক না থাকলে তাদের কষ্ট হবে। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যেকটি মানুষের ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করে দিতে বলেছেন। টিন ও গৃহ নির্মাণ মজুরি বাবদ নগদ অর্থ দিতে বলেছেন। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দেওয়া গতকাল সকালের তথ্যমতে, গঙ্গা ব্যতীত দেশের সব প্রধান নদীর পানি কমছে। ২৪ ঘণ্টায় পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের ২১টিতে পানি বেড়েছে, কমেছে ৭৫টির। অপরিবর্তিত রয়েছে পাঁচটি নদীর পানি সমতল। আজ মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি আরও ঘনীভূত হয়ে বর্তমানে সুস্পষ্ট লঘুচাপ আকারে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থান করছে। এতে আজ বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে দেশের বিভিন্ন অংশে। খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায়; সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুই-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।

এদিকে চার দফা বন্যায় উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের ৩৩ জেলার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব সরকারের প্রতিবেদনে উঠে আসলেও সাম্প্রতিক অতি বর্ষণ ও অস্বাভাবিক জোয়ারে তলিয়ে যাওয়া উপকূলীয় এলাকাগুলোর চিত্র এখনো উঠে আসেনি। এসব এলাকায় জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে হাজার হাজার ঘেরের রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি। পথে বসেছেন অনেক মাছচাষি। বন্যা নিয়ে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও তথ্য-

বাগেরহাট : গত কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে জেলার পাঁচ হাজার ২৭৪টি চিংড়ি খামার। ক্ষতিক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়ি চাষিরা। এই অবস্থায় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন জেলার অনেক চিংড়ি চাষি। মৎস্য বিভাগ জানায়, রপ্তানি পণ্য চিংড়ি উৎপাদনে দেশের প্রথম সারির জেলা বাগেরহাট। উপকূলীয় এ জেলায় ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে সাড়ে ৭৮ হাজার খামারে বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ হয়। উৎপাদিত চিংড়ির ৯৫ ভাগই রপ্তানি হয়। আগস্ট মাস থেকে শুরু হয় চিংড়ি আহরণ মৌসুম। সরকারি হিসাবেই জেলার বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল, মোংলা ও চিতলমারী উপজেলার পাঁচ হাজার ২৭৪টি চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে। সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে মোংলা ও মোরেলগঞ্জের চিংড়ি চাষিদের। মোংলায় এক হাজার ৭৬৫টি এবং মোরেলগঞ্জে দুই হাজার ২৬৫টি ঘের ডুবেছে জোয়ারের পানিতে। বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরে আমরা ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। যখনই চাষিরা মাছ বিক্রি শুরু করল, তখনই জোয়ারের পানিতে মাছের ঘেরগুলো তলিয়ে মজুদ চিংড়ি ভেসে গেল।

ভোলা : ভেঙে যাওয়া শহর রক্ষাবাঁধ মেরামতের কাজ শেষ হয়েও হলো না। আবারও বাঁধ ধসে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। গতকাল জোয়ারের চাপ কম থাকায় দুই-চারটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে এখনো অন্তত ১০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, গত বৃহস্পতিবার সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা ইউনিয়নের সাজিরকান্দি এলাকায় বাঁধ ভেঙে মেঘনার পানিতে অন্তত ১২টি গ্রাম তলিয়ে যায়। ওই সময় থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড দিন-রাত বাঁধ মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে সোমবার বিকাল পর্যন্ত পাইলিং করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউবে বালি ভরে বাঁধ মেরামতের কাজ শেষ করে এনেছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় পানির চাপে আবারও ১০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। তবে দুয়েক দিনের মধ্যে বাঁধ মেরামতের আশ্বাস দিয়েছে পাউবো।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর