বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ভবদহের জলাবদ্ধতায় ৪০ গ্রামে পানি

তিন লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ

সাইফুল ইসলাম, যশোর

ভবদহের জলাবদ্ধতায় ৪০ গ্রামে পানি

মনিরামপুর উপজেলার হাঁটাগাছা গ্রামে জলাবদ্ধতা। বাঁশের সাঁকোতে অতি সতর্কতায় বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন তারাপদ বৈরাগী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

যশোরের দুঃখ ভবদহ এলাকায় আবারও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে ৪০টি গ্রামের বসতবাড়িতে পানি ঢুকেছে। প্রতিদিনই তা বেড়ে চলেছে। মানুষ ঘরে থাকতে পারছে না। রান্নাঘর, উঠোন, টয়লেট, চাষের জমি সব পানিতে টইটম্বুর। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি নিয়েও বিপদ। এসব গবাদিপশুর খাবার পাওয়া যাচ্ছে না, বিক্রিও করা যাচ্ছে না। ক্রেতা নেই। ক্রেতা পাওয়া গেলেও পানির দামে বেচতে হচ্ছে। আবদ্ধ পানিতে ইতিমধ্যে পচন শুরু হয়েছে। তা থেকেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে চর্মরোগসহ বিভিন্ন অসুখ। অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম সরেজমিন ঘুরে সেখানকার মানুষের এরকম দুর্বিষহ অবস্থা দেখা গেছে। ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য স্থানীয় মানুষকে সংগঠিত করে গত ৪০ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলা গ্রামের রণজিৎ বাওয়ালি। এখনো তিনি ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক। এবারের বৃষ্টিতে পানি জমে গেছে তার নিজের বাড়িতেও। বললেন, ‘আমার গ্রামে ১৪৮টি বাড়ি আছে। ১০০ বাড়িতে ইতিমধ্যে জল উঠেছে। যেভাবে জল বাড়ছে, তাতে বাকি বাড়িগুলোতে শিগগিরই জল উঠে যাবে’। তিনি বলেন, ভবদহ অঞ্চলের ৪০ গ্রাম ইতিমধ্যে পানিতে ডুবে গেছে। মানুষের কাজ নেই, বাড়িতেও থাকার উপায় নেই। অসহায় অবস্থা। একই গ্রামের দিলীপ ঠিকাদার জানান, তার উঠোনে হাঁটুপানি। স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘরে থাকেন। বাইরে বেরোলেই পচা পানিতে ভিজে যেতে হয়। বাড়ির সবারই চর্মরোগ হয়ে গেছে। মনিরামপুর উপজেলার হাটাগাছা গ্রামের রণজিৎ বলেন, ‘চাষের জমি, বাড়ি সবই জলের নিচে। এখানে সেখানে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছি। সারা দিন যে মাছ পাই তা বিক্রি করে এক-আধ কেজি চালও কিনতে পারছি না’। একই গ্রামের প্রভাস বৈরাগী বলেন, ‘আয়-ইনকামের সব রাস্তা বন্ধ। রান্না করার জায়গা নেই। গরুর খাবারের দাম কয়েকগুণ বেশি। বেঁচে থাকার জন্য দুটো গরু পানির দামে বিক্রি করেছি। বাকি দুটো গরু কেনার ক্রেতাও পাচ্ছি না।’ হাটাগাছা গ্রামের দেবী ম-লের শোবার ঘরে মাজা-পানি, রান্নাঘর ডুবে গেছে। ডুবে গেছে টয়লেটও। কয়েকটা হাঁস-মুরগি নিয়ে পাশের ইটের রাস্তায় টংঘর করে সেখানে বসবাস করছেন এক মাস ধরে। ডহর মশিয়াহাটি গ্রামের সরস্বতী বিশ^াস বলেন, ‘এলাকার সব মানুষেরই চর্মরোগ হয়ে গেছে। অন্য জায়গায় বন্যা হলে কিছুদিন পর পানি নেমে যায়। আমাদের এলাকায় একবার পানি ঢুকলে আর নামে না। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনপ্রতিনিধি সবাই ছুটে বেড়াচ্ছেন নদী কাটার প্রজেক্টের পেছনে। নদী কাটলে ফাঁকি দেওয়া যায় বেশি, লুটপাট করা যায় বেশি। তিনি বলেন, ‘আমাদের তিন ফসলি জমিকে তারা জলাভূমি করতে চাচ্ছেন। আমরা চাষি। আমাদের গোলাভরা ধান ছিল, গরু ছিল, লাঙল ছিল, গাছ-গাছালি ছিল। পানির কারণে সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব লুটপাটের নদী কাটার প্রজেক্ট বাতিল করতে হবে। এ এলাকার ভূমি গঠন প্রক্রিয়া প্রকৃতির হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সব নদীর সঙ্গে বিলের সংযোগ করে দিতে হবে। জোয়ারাধার বা টিআরএম চালু করতে হবে। তাতে এমনিতেই ভবদহ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। টাকা-পয়সা লাগবে না’। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার যশোরে প্রায় দ্বিগুণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। গত বছর মে-আগস্ট চার মাসে ৭৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এ বছর এই চার মাসে ইতিমধ্যে ১২৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম বলেন, এবার বৃষ্টি বেশি হয়েছে এবং জোয়ারের পানির উচ্চতাও অনেক বেড়েছে। জোয়ারে আম্ফানের সময়ের চেয়েও ১ ফুট বেশি পানি আসছে। এ অবস্থায় খাল দিয়ে যে পানি নিষ্কাশন হতো, তার চেয়ে নদীর পানির উচ্চতা বেশি হওয়ায় পানি বের হতে পারছে না। ফলে ভবদহ এলাকার পানি ৯ ইঞ্চি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নদীর পানির লেভেল ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। শিগগিরই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। তিনি বলেন, ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে একটি প্রজেক্ট প্রস্তাবনা দাখিল করা আছে। এ ছাড়া আমডাঙ্গা চ্যানেল ২১ ভেন্টের সামনের অংশটা খনন করে পানি নামার পথ চালু রাখার চেষ্টা করছি। যে প্রজেক্ট প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে আরও স্টাডি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্টাডিতে যদি দেখা যায় যে জোয়ারাধার করা ভালো হবে, তাহলে সেটাও এই প্রজেক্টে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

সর্বশেষ খবর