করোনাকালে গার্মেন্টে ছাঁটাই আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না। এই আতঙ্ক ছড়িয়ে শ্রমিকদের বাড়তি কাজের চাপে রাখা হচ্ছে। জানা গেছে, দফায় দফায় মালিকরা সরকারি সুবিধা পেলেও শ্রমিকরা পেয়েছেন বঞ্চনা। কম সুদের ঋণ ও কর প্রণোদনা পেতে শ্রমিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন মালিকরা। শ্রমিক নেতারা বলছেন, গার্মেন্টে নীরব ছাঁটাই চলছে। মালিকরা একদিকে শ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে গার্মেন্ট শ্রমিকদের এক ধরনের নির্যাতন ও শ্রম শোষণ করা হচ্ছে। কিছু কারখানা শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটি দিচ্ছে না। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শ্রমিকরা চাপের মধ্যে আছে। গার্মেন্টে নীরব ছাঁটাই চলছে। প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের চাকরি হারানোর শঙ্কা বাড়ছে। কিছু কারখানা মালিক ও বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান অমানবিক আচরণ করছে। তারা সামাজিক দায়বদ্ধতা ভুলে গেছে। ফলে কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের চাপ বাড়ছে। তার মতে- আগে কারখানাগুলোতে শ্রমিক সংকট ছিল, এখন তা নেই। ফলে শ্রমিকরা একবার চাকরি হারালেই বিপদে পড়ছেন। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাকালে দফায় দফায় শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে গার্মেন্টসে। এই ছাঁটাই চলমান রেখেই কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মালিকরা একদিকে কাজের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন, অন্যদিকে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারখানাগুলোতে ভালো নেই পোশাক শ্রমিকরা। কিছু কিছু কারখানা শ্রমিকদের শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি দিচ্ছে না। কম বেশি সব কারখানাতেই শ্রমিকরা চাপে আছে। আবার মালিকদের একটা বড় অংশ বলছে কাজ নেই। কিন্তু কারও কারও কাজ থাকার পরও মিথ্যা কথা বলছেন। চলমান সংকট উত্তরণে ড্রাগন, এ ওয়ান, ইউনিক ও মিতালী ফ্যাশনসহ বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। তবে বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাকালে যখনই আমরা একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখনই দ্বিতীয় ধাক্কা এসেছে। এখন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। প্রতিনিয়ত সংকট বাড়ছে। এখন সবাই মাঝ পথে আছি। মালিকরা অস্তিত্ব রক্ষার চাপে আছেন। মালিকরা না বাঁচলে শ্রমিকদের টিকে থাকা কঠিন হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) মাঠ জরিপে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে পোশাক খাতের পুরুষ কর্মীরা গড়ে মাত্র ৪৩ ঘণ্টা এবং নারী কর্মীরা ৪২ ঘণ্টা কাজ করেন। মে মাস থেকে কর্মঘণ্টা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আগস্ট সেপ্টেম্বরে তা আবার ২০১৯ সালের মতো মাসে ২৪৬ ঘণ্টায় ফিরে আসে। কর্মীদের বেতন পরিশোধের জন্য সরকারের দেওয়া স্বল্প সুদের ঋণ পোশাক কারখানা মালিকদের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রসদ জোগায়। শ্রমিকদের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন পরিশোধ করতে ৪ শতাংশ সুদে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় পোশাক খাতে। পরে জুলাই মাসে দেওয়া হয় আরও প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। করোনাকালে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পে অর্ডার বাড়ছে। কিন্তু বৈশ্বিক ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষিতে ব্যর্থ হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। আবার ক্রেতাদের অনৈতিক চাপেও দাম কমছে। এই সংকট উত্তরণে পোশাকশিল্প মালিকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানোর তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়ে দাম কমিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা। আবার একই ক্রেতা চীন ও ভিয়েতনামে বাড়তি মূল্য দিচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো- ইপিবির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে- করোনাকালে জুলাইয়ের পর আগস্টেও বেড়েছে রপ্তানি আয়। পোশাক শিল্পের ওপর ভর করে রপ্তানিতে এই প্রবৃদ্ধির দেখা মিলেছে। সেপ্টেম্বর মাসেও রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির খবর এসেছিল পোশাক খাত থেকে। অক্টোবর মাসে এসে সেই ধারায় ছেদ পড়েছে। এর আগে জুনে পোশাক রপ্তানিতে ৬ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও পরের তিন মাসের (জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর) পরিস্থিতি কারখানা মালিকদের মনে সাহস ফিরিয়ে আনে। কিন্তু অক্টোবরের ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি আবার নতুন করে শঙ্কা জাগাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ওভেন পোশাক রপ্তানি খুব ভালো করতে না পারলেও নিট পোশাকের রপ্তানি ছিল বেশ আশাব্যঞ্জক। সব মিলিয়ে জুলাই মাসে পোশাক রপ্তানিতে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়, এরপর আগস্ট মাসে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৩ দশমিক ০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। কিন্তু অক্টোবর মাসে এসে আগের বছরের ওই মাসের চেয়ে রপ্তানি কমে গেছে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।